সৌদি আরবে পবিত্র রমজান মাসের চাঁদ দেখা যাওয়ার খবর মুসলিম বিশ্বে গভীর উচ্ছ্বাস তৈরি করেছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় সৌদি কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেছে যে নতুন চাঁদ দেখা গেছে এবং ফলস্বরূপ শনিবার (১ মার্চ) থেকে দেশটিতে রমজান মাস শুরু হবে। অর্থাৎ ১৪৪৬ হিজরি সনের রমজান মাসের প্রথম দিন ১ মার্চ তারিখে পালন করা হবে। এই ঘোষণার পরেই মসজিদগুলোতে এশার নামাজের পর তারাবিহ’র বিশেষ নামাজ শুরু হয়, যা রমজানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য। বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা সৌদি আরবের এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে একে অপরকে রমজান মোবারক জানাতে শুরু করেছেন।
রমজানের চাঁদ দেখা: ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক দিক
ইসলামী চান্দ্র বর্ষপঞ্জিতে প্রতিটি মাসের শুরু নির্ধারিত হয় আকাশে নতুন চাঁদের সরু বাঁকা আগমন (হিলাল) দেখার মাধ্যমে। পবিত্র কুরআনে নির্দেশিত এবং হাদিসের শিক্ষায় বলা হয়েছে যে চাঁদ দেখেই রমজান মাস শুরু করতে হবে এবং চাঁদ দেখেই রোজার সমাপ্তি ঘোষণা করতে হবে। হাদিসে প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা) বলেছেন: “তোমরা চাঁদ দেখলে রোজা রাখা শুরু করো এবং চাঁদ দেখলে রোজা ভঙ্গ (ঈদ উদযাপন) করো। যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে এবং চাঁদ দেখা না যায়, তাহলে শাবান মাসকে ৩০ দিনে পূর্ণ করো।” – সহীহ বুখারি ও মুসলিম। এই সুন্নতের উপর ভিত্তি করেই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলিম সমাজ রমজানের শুরু ও শেষ নির্ধারণ করে আসছে। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে (২য় হিজরিতে) রমজানের রোজা পালনের বিধান প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে শাবান মাসের শেষ রাতে নতুন চাঁদ দেখার এই প্রথা ইসলামের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। চাঁদ দেখার মাধ্যমে রমজান শুরুর এ পদ্ধতি মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক এবং আল্লাহর নির্দেশের প্রতি আনুগত্যের নিদর্শন হিসেবে গুরুত্ব পেয়ে আসছে।
রমজানের নতুন চাঁদ দেখা ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান, কেননা এটি থেকেই পবিত্র রোজার মাসের সূচনা হয়। ইসলামী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী চন্দ্রমাস ২৯ বা ৩০ দিনের হয়ে থাকে এবং আকাশে চাঁদ দেখা সাপেক্ষে তা নির্ধারিত হয়। আকাশ পরিষ্কার থাকলে শাবান মাসের ২৯তম দিনের সন্ধ্যায় বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা অধীর আগ্রহে পশ্চিমাকাশে সরু বাঁকা চাঁদ খোঁজেন। যদি চাঁদ দেখা না যায়, তবে শাবান মাস ৩০ দিনে পূর্ণ করে পরদিন থেকে রমজান গণনা করা হয়। শতাব্দী প্রাচীন এই চাঁদ দেখার প্রথা আধুনিক যুগেও অব্যাহত রয়েছে, যদিও আজকাল টেলিস্কোপ ও প্রযুক্তির সহায়তায় দেখার প্রচলন হয়েছে। তবুও এই প্রথাগত পদ্ধতির মাধ্যমে রমজান শুরু করাকেই অধিকাংশ মুসলিম সমাজ ধর্মীয়ভাবে সঠিক ও স্বস্তিদায়ক বলে মনে করে।
সৌদি আরবে রোজা শুরুর গুরুত্ব ও ঐতিহ্য
ইসলামের জন্মভূমি সৌদি আরবে রমজান মাস এক বিশেষ মাহাত্ম্য নিয়ে আসে। মক্কায় অবস্থিত পবিত্র কাবা শরিফ এবং মদিনায় মসজিদে নববী এই মাসে লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসল্লির পদচারণায় মুখর থাকে। রমজান শুরুর সাথে সাথে সৌদি সমাজে এক বিশেষ উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং দীর্ঘ ঐতিহ্য হিসেবে পরিবারগুলো একত্রে ইফতারের আয়োজন করে থাকে। খেজুর, সাম্বুসাক, আরবি কাহওয়া (কফি) সহ নানা ঐতিহ্যবাহী সৌদি খাবার ইফতারে পরিবেশিত হয়। দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যে এবং সরকারি অফিসে কর্মঘণ্টা সমন্বয় করা হয় যাতে রোজাদাররা কাজের পাশাপাশি ইবাদতের সুযোগ পান। রমজানের আগমন উপলক্ষে সৌদি সরকার বিশেষ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করে – মসজিদগুলোতে অতিরিক্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা, এবং ইবাদতকারীদের সুবিধার্থে সময়সূচি পরিবর্তন থেকে শুরু করে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়।

রমজান শুরুর সাথে সাথে অসংখ্য মানুষ সৌদি আরবে ওমরাহ পালন ও প্রথম তারাবিহ আদায়ের উদ্দেশ্যে সমবেত হন। অনেকেই বিশ্বাস করেন রমজান মাসে ওমরাহ করা হজের ন্যায় সওয়াবের কাজ, তাই বিশ্বের নানাপ্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মাসটির শুরুতেই মক্কায় জমায়েত হন। পবিত্র মক্কা নগরীতে রমজানের প্রথম রাতের তারাবিহ নামাজ আদায় করতে হাজারো মানুষ একত্রিত হন এবং আল্লাহর দরবারে বিশেষ ইবাদতে মশগুল হন। এভাবে সৌদি আরবে রোজা শুরুর ঐতিহ্য কেবল দেশটির নিজস্ব সংস্কৃতিই নয়, বরং বিশ্ব মুসলিমের হৃদয়ে উদ্দীপনা জাগায়। সৌদি আরবে চাঁদ দেখা যাওয়ার ঘোষণার পর মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেক অঞ্চলে একই দিনে রমজান শুরু হয়, যা বহু দেশের জন্য তারিখ নির্ধারণের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে, সৌদি আরবে রোজা শুরুর ঘটনাটি আন্তর্জাতিকভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
তারাবিহ নামাজ ও রমজানের ইবাদতের গুরুত্ব
রমজান মাস মূলত সুবেহ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সিয়াম সাধনার সময়, তবে এই মাসে শুধু রোজা রাখাই নয়, ইবাদত-বন্দেগিতেও থাকে বিশেষ তৎপরতা। তারাবিহ নামাজ হলো রমজানের প্রতি রাতে এশার নামাজের পর অতিরিক্ত জামাতের নামাজ, যা কুরআন তেলাওয়াত ও গভীর ঐকান্তিকতার সাথে আদায় করা হয়। রাসূল (সা) জীবদ্দশায় তারাবিহ’র প্রচলন করেন এবং পরে খেলাফতে উমর (রা) এর সময় থেকে মুসলিম সমাজে এটি জামাতে পড়ার রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারণত প্রতিটি রাতে কুরআনের অংশ বিশেষ তেলাওয়াত করা হয় যাতে পুরো রমজানে সম্পূর্ণ কুরআন খতম সম্পন্ন হয়। তারাবিহ নামাজ মুসলিমদের জন্য ফরজ নয়, বরং একটি সুন্নত মুয়াক্কাদাহ (জোরালো সুন্নত) ইবাদত, যা আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ এনে দেয়।

রমজানের তারাবিহ নামাজ মুসলিম সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ এবং ঐক্যের এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করে। মসজিদে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে শত শত মুমিন একসাথে আল্লাহর সামনে মাথা নত করেন, যা দেখতে এক অনুপম দৃশ্য। বিশেষ করে হারামাইন শরিফাইনের (মক্কা ও মদিনার প্রধান দুই মসজিদ) তারাবিহ জামাতে হাজীদের ঢল নামার ঘটনা বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত। ২০২৪ সালে রমজানের ২৯তম রাতে মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদে এশা ও তারাবিহ নামাজে ২৫ লাখেরও বেশি মুসল্লি অংশ নেন, যা এই রাত্রীকালীন ইবাদতের মহিমা প্রদর্শন করে। একইভাবে মদিনার মসজিদে নববীতেও বিপুল সংখ্যক মুসল্লি তারাবিহে অংশ নেন এবং পূরণ করেন পবিত্র কুরআন খতমের সুন্নত। রাতের নিভৃত ইবাদত ও তারাবিহ’র প্রতি এই আন্তরিকতা মুসলিমদের আত্মশুদ্ধি, ত্যাগ ও তাকওয়া অর্জনের পথকে আরো মসৃণ করে এবং পুরো রমজান জুড়ে একটি আধ্যাত্মিক পরিবেশ বজায় রাখে।
সৌদি ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের ঘোষণা ও প্রক্রিয়া
রমজানের চাঁদ দেখার বিষয়টি সৌদি আরবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে নেওয়া হয় এবং এ নিয়ে একটি সুশৃঙ্খল প্রক্রিয়া রয়েছে। সৌদি সুপ্রিম কোর্ট ও চাঁদ দেখা কমিটি শাবান মাসের ২৯ তারিখে দেশের বিভিন্ন স্থানে পর্যবেক্ষক দলের মাধ্যমে আকাশ পর্যবেক্ষণের উদ্যোগ নেয়। সাধারণ মানুষকেও চাঁদ দেখার আহ্বান জানানো হয় এবং কোথাও চাঁদ দেখা গেলে তা নিকটস্থ কর্তৃপক্ষকে জানাতে উৎসাহিত করা হয়। চলতি বছরেও সৌদি আরবের প্রধান জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আগেই আশা প্রকাশ করেছিলেন যে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ওই সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা যেতে পারে। অবশেষে প্রত্যাশা অনুযায়ী চাঁদ দেখা গেলে সরকারিভাবে ঘোষণা দেওয়া হয় যে পরদিন থেকে রোজা শুরু হবে। সৌদি প্রেস এজেন্সি ও টেলিভিশনের মাধ্যমে এই ঘোষণা সারাদেশে সম্প্রচারিত হয়, ফলে মুহূর্তের মধ্যেই খবরটি সবার কাছে পৌঁছে যায়। যারা চাঁদ দেখার অপেক্ষায় ছিলেন, তারা সঙ্গে সঙ্গেই তারাবিহ নামাজের প্রস্তুতি নিতে থাকেন এবং রমজানের শুভ সূচনার জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন। সৌদি আরবে চাঁদ দেখা নিশ্চিত হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যসহ বহু দেশের ইসলামিক কর্তৃপক্ষ একই দিন রমজান শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদিকে, যে দেশগুলোতে ওই সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা যায়নি, সেগুলো ঐতিহ্য অনুযায়ী শাবান মাস ৩০ দিনে পূর্ণ করে পরবর্তী দিন থেকে রমজান শুরু করে।
বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া
সৌদি আরবে চাঁদ দেখা যাওয়ার ঘোষণাটি বিশ্বের প্রায় ১৮০ কোটি মুসলমানের হৃদয়ে আনন্দের সঞ্চার করেছে। সাধারণত রমজানের চাঁদ সৌদি আরব ও কাছাকাছি কিছু অঞ্চলে আগে দেখা গেলে দক্ষিণ এশিয়া ও অন্যান্য দেশে একদিন পর রোজা শুরু হয়। যেমন, সৌদিতে শনিবার রোজা শুরু হলে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আশেপাশের দেশে প্রায়ই রবিবার থেকে রোজা শুরু হয় যদি সেদিন চাঁদ দেখা না যায়। এতে করে মুসলিম বিশ্বে রমজানের শুরুটা ভৌগোলিক অবস্থানভেদে এক থেকে দুই দিনের ব্যবধানে হলেও সার্বিক উৎসাহের কমতি হয় না। চাঁদ দেখা ও রমজান শুরুর ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে “রমজান মোবারক” এবং “Ramadan Mubarak” শুভেচ্ছা বার্তায় ভরে যায়। বিশ্বের নেতা-বিজ্ঞগ্ণও মুসলমানদের রমজানের শুভেচ্ছা জানান, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রিতি ও বহুসাংস্কৃতিক বন্ধনের উদাহরণ সৃষ্টি করে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিম সম্প্রদায়গুলো ঈমানি উন্মাদনায় রাতেই মসজিদে জমায়েত হয়ে তারাবিহ নামাজ আদায় শুরু করেন এবং পরদিন ভোরে প্রথম সেহরি খাওয়ার মাধ্যমে রোজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন।
বিশ্বের মুসলিমরা রমজানকে কেবল আত্মশুদ্ধির সময় হিসেবেই দেখেন না, বরং এটি পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সংহতি প্রদর্শনেরও সময়। ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবাই এক সাথে উপবাস ও ইবাদত পালন করেন, যা সামাজিক সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধকে মজবুত করে। সৌদি আরবে চাঁদ দেখার মাধ্যমে রমজান শুরুর বার্তা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া মুসলিমদের মাঝে এক নতুন উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলে। সব মিলিয়ে, সৌদি আরবে রমজানের চাঁদ দেখা যাওয়ার ঘটনা ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা প্রতি বছরই সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য আনন্দ ও তাত্পর্য নিয়ে আসে।