গাজা পুনর্নির্মাণের পরিকল্পনা ও আরব উদ্যোগঃ
কায়রোতে অনুষ্ঠিত এই জরুরি আরব শীর্ষ সম্মেলনে গাজা পুনর্গঠনের জন্য একটি সমন্বিত রোডম্যাপ উপস্থাপন ও অনুমোদন করা হয়েছে। মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি সম্মেলনে গাজা পুনর্গঠনের একটি বিস্তৃত পরিকল্পনা পেশ করেন, যার লক্ষ্য হলো গাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন করে জীবন ও অবকাঠামো গড়ে তোলা, তবে একজন ফিলিস্তিনিকেও তাদের ভূমি থেকে উৎখাত না করা। এই পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো নিচে তুলে ধরা হলো:
- পুনর্গঠনের পরিধি ও বাজেট: মিসরের পরিকল্পনায় গাজা পুনর্গঠনের আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিভিন্ন পর্যায়ে বিনিয়োগ করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী পুনর্গঠনকাজ সম্পন্ন হতে প্রায় পাঁচ বছর সময় লাগবে এবং প্রথম দুই বছরে অগ্রাধিকারভিত্তিতে জরুরি আবাসন ও অবকাঠামো নির্মাণে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে ২ লাখ নতুন বাড়ি নির্মাণের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। গাজার জমিগুলো কীভাবে পুনর্গঠিত ও উন্নয়ন করা হবে তার জন্য ১১২ পৃষ্ঠার একটি নকশা নথি প্রস্তুত করা হয়েছে, যেখানে নতুন আবাসিক এলাকা, উদ্যান, কমিউনিটি সেন্টার ইত্যাদির পরিকল্পনা রয়েছে। এতে একটি বাণিজ্যিক সমুদ্রবন্দর, আধুনিক প্রযুক্তি পার্ক, সমুদ্র তীরবর্তী পর্যটন কেন্দ্র ও একটি বিমানবন্দর স্থাপনের কথাও উল্লেখ আছে, যা গাজাকে ভবিষ্যতে আত্মনির্ভর অর্থনীতি গড়তে সহায়তা করবে।
- জনগণকে স্থানে রেখেই পুনর্বাসন: পরিকল্পনার মূল নীতি হলো গাজার অধিবাসীদের তাঁদের নিজ ভূমিতেই রেখে পুনর্গঠন কাজ সম্পাদন করা। অর্থাৎ বাহ্যিক কোনো দেশে ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তরের প্রস্তাব আরব দেশগুলো সর্বসম্মতিক্রমে নাকচ করেছে। আরব নেতৃবৃন্দ স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক স্থানান্তর কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না । বাহরাইনের বাদশাহ হামাদ বিন ইসা আল খলিফা, যিনি এবারের আরব সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন, উদ্বোধনী ভাষণে বলেছেন: “আমরা ফিলিস্তিনিদের স্থানচ্যুত করার যে কোনো প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যান করি এবং দ্বিরাষ্ট্র সমাধানকে সমর্থন করি”। এই ঐকমত্য নির্দেশ করে যে গাজার জনগণ গাজাতেই থাকবে এবং সেখানেই তাদের জন্য ঘরবাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল সব নির্মিত হবে।
- শাসন ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কাঠামো: গাজা পুনর্গঠন ও ব্যবস্থাপনার জন্য একটি স্বাধীন এবং অস্থায়ী প্রশাসনিক কমিটি গঠন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। মিসর ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের পরামর্শে গঠিত এই কমিটিতে স্বাধীন ও পেশাদার ফিলিস্তিনি টেকনোক্র্যাটরা থাকবেন, যারা গাজার দৈনন্দিন প্রশাসন ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করবেন। তাদের কাজ হবে পুনর্গঠন কার্যক্রম সমন্বয়, আন্তর্জাতিক ত্রাণ বণ্টন নিশ্চিত করা এবং ধাপে ধাপে নিরাপত্তা স্থিতিশীল করা। এই কমিটি অস্থায়ী সময়ের জন্য গাজা শাসন করবে এবং প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষের (পিএ) প্রত্যাবর্তনের পথ সুগম করবে। মূল উদ্দেশ্য হলো, গাজা যেন সরাসরি নির্বাচিত ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব (পিএ/পিএলও) এর আওতায় ফিরে যেতে পারে, যাতে একটি ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিনি শাসন গড়ে ওঠে। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এই মিশরীয় উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরি হলে নতুন প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচনের কথা বলেছেন, যা ফিলিস্তিনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
- হামাসের ভবিষ্যৎ ও নিরাপত্তা: অবশ্য গাজার শাসন ও নিরাপত্তা নিয়ে একটি জটিল প্রশ্ন রয়ে গেছে – হামাসের ভূমিকা কী হবে। আরব দেশগুলো এই প্রসঙ্গে অভ্যন্তরীণভাবে পরামর্শ চালিয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত যেমন হামাসের সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ ও নিরপেক্ষীকরণ অবিলম্বে চায়, অন্যদিকে কাতার ও তুরস্কের মতো দেশগুলো কিছুটা ধীরপথে সমঝোতার পক্ষে। সৌদি আরবও ইঙ্গিত দিয়েছে যে হামাস সশস্ত্র থাকলে পুনর্গঠনে পশ্চিমা ও ইসরায়েলি সম্মতি পাওয়া কঠিন। তবে হামাসের নেতৃস্থানীয়রা প্রকাশ্যে তাদের নিরস্ত্রীকরণ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বলেছে যে প্রতিরোধের অধিকার ছাড়বে না। সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক আলোচনায় হামাসের প্রসঙ্গ সরাসরি না আসলেও, পর্দার আড়ালে এ ব্যাপারে আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মতবিনিময় হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, আপাতত হামাসকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত না করে একটি স্বাধীন প্রশাসন দিয়ে গাজা চালানো হবে, যাতে পুনর্গঠন ও মানবিক সহায়তা বাধাপ্রাপ্ত না হয়। একইসাথে দীর্ঘমেয়াদে গাজায় নির্বাচনের মাধ্যমে বৈধ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার পর হামাসের ভবিষ্যৎ ভূমিকা নির্ধারণ হবে।
- আন্তর্জাতিক সহায়তা ও তহবিল: আরব নেতারা বুঝেছেন যে এত বিশাল পুনর্গঠন প্রচেষ্টা সফল করতে বৈশ্বিক সহায়তা অপরিহার্য। তাই সম্মেলনে একটি বিশেষ পুনর্গঠন তহবিল গঠনের প্রস্তাব আসে, যেখানে ধনী আরব রাষ্ট্র (সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত প্রমুখ) ও আন্তর্জাতিক দাতারা অবদান রাখবে। মিসরের প্রেসিডেন্ট সিসি ঘোষণা দিয়েছেন যে গাজা পুনর্গঠনের জন্য আগামী এপ্রিল মাসে একটি আন্তর্জাতিক দাতা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে, যাতে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপানসহ সকল বড় দাতা দেশ ও সংস্থা অংশ নেবে। তাঁর আহ্বান, আরব বিশ্বকে নিজেদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সক্রিয় হতে হবে এবং একই সাথে বৈশ্বিক সম্প্রদায়কে এই মহাযজ্ঞে শামিল করতে হবে। ইতোমধ্যে কাতার ও তুরস্ক গাজা পুনর্গঠনে বিশেষ তহবিল ঘোষণার ইঙ্গিত দিয়েছে, সৌদি আরবও উল্লেখযোগ্য অনুদান দিতে প্রস্তুত বলে জানা গেছে। এভাবে আর্থিক সংস্থান ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান দুটি থেকেই সহায়তা নিয়ে গাজার পুনর্গঠন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ চলছে।
সর্বোপরি, সম্মেলনের মূল বার্তা ছিল যে গাজার ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি জনগণের হাতেই থাকবে এবং আরব বিশ্ব এই পুনর্গঠনে নেতৃত্ব দেবে। এতে দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের ভিত্তিতে স্থায়ী শান্তির পথও সুগম হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ইসরায়েলের ভূমিকা: অবরোধ, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন ও তার প্রভাব
গাজা পুনর্গঠনের পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক যে রাষ্ট্র, তা হলো ইসরায়েল। আরব নেতারা যখন ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করছেন, ইসরায়েল তখনও বিভিন্ন উপায়ে এই প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে, মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা প্রদান এবং যুদ্ধবিরতির শর্ত ভঙ্গ করার জন্য ইসরায়েল কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে।

প্রথমত, গাজার উপর ইসরায়েলের অবরোধ অব্যাহত রয়েছে। যুদ্ধবিরতির পরেও ইসরায়েল সীমান্তে কড়াকড়ি বজায় রেখেছে, জীবনরক্ষাকারী ত্রাণ সামগ্রী, খাদ্য, ওষুধ এবং জ্বালানি প্রবেশে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করছে। মিসরের রাফাহ ক্রসিং সীমিত সময়ের জন্য খোলা হলেও, ইসরায়েলি অনুমতি ছাড়া প্রয়োজনীয় সরবরাহ গাজার ভেতরে পুরোপুরি পৌঁছাতে পারছে না। ফলে গাজার লাখো মানুষ এখনও বিদ্যুৎ ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে এবং অনাহারের প্রান্তে দিন কাটাচ্ছে। মিশরের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আল-আযহার ইসরায়েলের এই অবরোধকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করে বলেছে, “মানবিক সাহায্য আটকে রেখে ইসরায়েল রমজানের পবিত্রতাকেও অগ্রাহ্য করছে এবং এটি আসলে নিষ্পাপ শিশু, নারী ও পুরুষদের ‘অনাহারে মারার অপরাধ’”। আল-আযহার আরও মন্তব্য করে যে ইসরায়েল মূলত ফিলিস্তিনিদেরকে “ক্ষুধায় মরো বা গাজা ছেড়ে পালাও” – এই দ্বিধার মুখে ফেলতে চাইছে, যা আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের চরম লঙ্ঘন।
দ্বিতীয়ত, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগও উঠেছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। জানুয়ারির মাঝামাঝি যে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি ও বন্দী-বিনিময় চুক্তি সম্পন্ন হয়, তা মূলত ধাপে ধাপে বাড়ানোর কথা ছিল। প্রত্যাশা ছিল, বন্দী বিনিময় ও ত্রাণ প্রবেশ অব্যাহত থাকলে শান্তির সময়সীমা আরও বাড়বে। কিন্তু কিছুদিন পরই ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশের আলোচনায় গড়িমসি শুরু করে এবং হঠাৎ গাজার মধ্যে ত্রাণ প্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বন্দী বিনিময়ের পরবর্তী ধাপ নিয়ে আলোচনা স্থগিত করেন, যার জেরে কয়েকদিন ধরে কোনো ত্রাণ ট্রাক গাজায় প্রবেশ করতে পারেনি। এই পদক্ষেপ কার্যত যুদ্ধবিরতির চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে দেখা হয় এবং এর ফলে গাজার জনগণের কষ্ট আরও বেড়ে যায়। আন্তর্জাতিক চাপে শেষমেশ কিছু ত্রাণ পুনরায় ঢুকতে শুরু করলেও, ইসরায়েল আবারও সামরিক কার্যক্রম শুরু করেছে কিনা সেই উদ্বেগ তৈরি হয়।
তৃতীয়ত, যুদ্ধবিরতির সময়েও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি অভিযান ও সহিংসতা চলতে থাকে, যা সামগ্রিক যুদ্ধবিরতির মানে ভূলুণ্ঠিত করে। গাজায় অস্ত্র বিরতি থাকলেও ইসরায়েলি বাহিনী ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে পশ্চিম তীরের বিভিন্ন এলাকা (যেমন নাবলুস, জেনিন) ঘিরে ঘরে ঘরে তল্লাশি ও গ্রেফতার অভিযান চালায় এবং বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা করে। অনেক পর্যবেক্ষক বলেছেন, ইসরায়েল আসলে গাজায় “দাঁত বসাতে না পারায়” পশ্চিম তীরকে নিশানা করছে, যা মোটেই প্রকৃত শান্তির পরিবেশ নয়।
ইসরায়েলের এসব কর্মকাণ্ডের গুরুতর কূটনৈতিক ও মানবিক প্রভাব পড়ছে। মানবিকভাবে, অবরোধ ও সহিংসতায় গাজার পুনর্বাসন দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে – ভেঙে পড়া অবকাঠামো মেরামতের জন্য যেসব নির্মাণ সামগ্রী দরকার, সেগুলো প্রবেশ করতে না পারায় মানুষ খোলা আকাশের নিচে আছে, জরুরি সেবা চালু করা যাচ্ছে না। ক্ষুধা, রোগ ও নিরাপত্তাহীনতা গাজাবাসীর দৈনন্দিন বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কূটনৈতিকভাবে, ইসরায়েল প্রায় একঘরে অবস্থায় পড়েছে; আরব বিশ্ব তো বটেই, বিশ্বের বহু দেশই ইসরায়েলের এই আচরণে ক্ষুব্ধ। এমনকি ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাষ্ট্রগুলোরও কিছু অংশ (যেমন ইউরোপ ও আমেরিকার জনমত) যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন ও অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহারের সমালোচনা করেছে। ইসরায়েলের প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থা নষ্ট হওয়ায় ভবিষ্যতে যে কোনো শান্তি আলোচনা উদ্যোগ জোরদার করা কঠিন হয়ে পড়বে, যদি না তারা মানবাধিকার ও চুক্তিপালনের প্রতি সম্মান দেখায়।
আরব লীগ সম্মেলনে বক্তারা ইসরায়েলের এই ভূমিকার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। মিসরের প্রেসিডেন্ট সিসি সরাসরি বলেছেন যে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল “গাজার মানুষকে উচ্ছেদ করা”, যা মানবতার কলঙ্ক। এ ধরনের ভূমিকা শান্তির পথে প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করে আরব রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইসরায়েলের জবাবদিহি নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: জাতিসংঘ, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বজনমত
গাজা সংকট ও এই জরুরি আরব সম্মেলন ঘিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন আঞ্চলিক জোট, মহাশক্তি ও সাধারণ মানুষ – সকলেই কোনো না কোনোভাবে তাদের অবস্থান প্রকাশ করেছে এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
- জাতিসংঘ: জাতিসংঘ শুরু থেকেই গাজায় সহিংসতা বন্ধ ও মানবিক সহায়তার পক্ষে জোরালো বক্তব্য দিয়ে আসছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে যখন নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয় (যুক্তরাষ্ট্র একাধিকবার প্রস্তাবে ভেটো করে), তখন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতায় গাজায় তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করে। সাধারণ পরিষদের ঐতিহাসিক ভোটে বিশ্ব সম্প্রদায় ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষায় এককাট্টা সমর্থন দেখায়। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেশ বরাবরই গাজার পরিস্থিতিকে “নরকতুল্য” বলে উল্লেখ করে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতি ও মানবিক করিডর তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন। মানবিক সহায়তার তহবিল জোগাড়ে জাতিসংঘ একাধিক জরুরি আবেদন করেছে – গত ডিসেম্বরেই জাতিসংঘ গাজার জন্য ৬.৬ বিলিয়ন ডলারের জরুরি তহবিল আহ্বান করে, যার একটি বড় অংশ তাৎক্ষণিক আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসা খাতে ব্যয় হবে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা (UNRWA, WFP, WHO ইত্যাদি) চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও গাজায় ত্রাণ সরবরাহের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ক্রমবর্ধমান চাহিদার তুলনায় অর্থায়ন অপ্রতুল এবং ইসরায়েলের বাধার কারণে অনেক জায়গায় তারা পৌঁছাতে পারছে না। এদিকে আন্তর্জাতিক আইনি ব্যবস্থাও সক্রিয় হয়েছে: হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) গত নভেম্বরেই গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। একই সাথে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (ICJ) গাজার ওপর ইসরায়েলের অভিযানের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদও গাজা পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ অধিবেশনে ইসরায়েলের সমালোচনা করে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এসব পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে বিশ্বজনমতের চাপে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ইসরায়েলকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে আগের চেয়ে বেশি সক্রিয়।
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশ: ইউরোপীয় দেশগুলো গাজা সংঘাত বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। একদিকে ফ্রান্স, জার্মানিসহ কিছু বড় রাষ্ট্র শুরুতে ইসরায়েলের “আত্মরক্ষার অধিকার”কে জোরালোভাবে সমর্থন জানালেও, সহিংসতা চরম পর্যায়ে পৌঁছালে তারা মানবিক বিরতির আবেদন জানাতে শুরু করে। আয়ারল্যান্ড, স্পেন, বেলজিয়ামসহ বেশ কিছু ইউরোপীয় দেশ সংসদীয়ভাবে ইসরায়েলের নিন্দা প্রস্তাব পাস করে এবং যুদ্ধবিরতির দাবি জানায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান জোসেপ বোরেল বলেন, গাজায় বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে যে মাত্রার বলপ্রয়োগ হয়েছে তা “অগ্রহণযোগ্য” এবং আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সঙ্গতিহীন। ইইউ ইতোমধ্যে গাজার জন্য উল্লেখযোগ্য মানবিক সহায়তা ঘোষণা করেছে এবং যুদ্ধবিরতির পর পুনর্গঠন প্রচেষ্টায় অবদান রাখতে প্রস্তুত রয়েছে। তদুপরি, কিছু ইউরোপীয় নেতা (যেমন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ) গাজা-পরবর্তী শান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছেন। অবশ্য ইউরোপের ভেতরেও মতপার্থক্য রয়ে গেছে – হাঙ্গেরি ও অস্ট্রিয়ার মতো কয়েকটি দেশ ইসরায়েলকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে গেছে এবং শরণার্থী ইস্যুতে কড়া অবস্থান নিয়েছে। তবু সামগ্রিকভাবে ইইউ দ্বিরাষ্ট্র সমাধানকেই একমাত্র পথ বলে পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং জেরুজালেমসহ ১৯৬৭ পূর্ব সীমান্ত অনুযায়ী একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের পক্ষে নিজেদের নীতিগত অবস্থান আরও – নিশ্চিত করেছে।
- যুক্তরাষ্ট্র: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে দুই পর্বে বিভক্ত করে দেখা যায় – যুদ্ধ চলাকালীন এবং যুদ্ধবিরতির সময়ে। সংঘাতের শুরুর দিকে ট্রাম্প প্রশাসন (ধরনার ক্ষেত্রে ২০২৫ সালে ট্রাম্প ক্ষমতায়) প্রকাশ্যে ইসরায়েলের অভিযানকে সমর্থন জানায় এবং জাতিসংঘে যে কোনো যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত প্রস্তাব আটকে দেয়। ফলে নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র একাধিকবার ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে ইসরায়েলবিরোধী প্রস্তাব পাস হতে দেয়নি। তবে যুদ্ধের মানবিক মাশুল ক্রমে বাড়তে থাকায় এবং মিত্র আরব দেশগুলোর চাপ বৃদ্ধির ফলে, ওয়াশিংটন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে শুরু করে। কাতারের সহযোগিতায় মার্কিন প্রশাসন হামাসের সাথে পরোক্ষ আলোচনা চালিয়ে একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি ও বন্দী-বিনিময় চুক্তি সরাসরি সফল করে – যেখানে হামাস তাদের হাতে আটক কিছু বন্দী (যাদের মধ্যে বিদেশী নাগরিক ও ইসরায়েলি নাগরিক উভয়ই ছিল) মুক্তি দেয় এবং এর বদলে ইসরায়েল গাজায় হামলা সাময়িক বন্ধ রাখে। এতে মার্কিন কূটনীতিকদের কৃতিত্ব দেওয়া হয় এবং আরব নেতারা প্রকাশ্যে ট্রাম্পের ভূমিকাকে স্বাগত জানান। তারপর, পুনর্গঠনের প্রস্তাব সামনে এলে আরব বিশ্বের দাবির মুখে যুক্তরাষ্ট্রও কিছুটা অবস্থান পরিবর্তন করে। ট্রাম্প প্রশাসনের বিতর্কিত “গাজা রিভিয়েরা” পরিকল্পনা যখন আরবরা এক বাক্যে প্রত্যাখ্যান করে, তখন মার্কিন পক্ষ বৃহত্তর শান্তি পরিকল্পনার আলোচনায় আগ্রহ দেখাতে শুরু করে। মিসরের প্রস্তাবিত গাজা পুনর্গঠন কমিটিকে শুরুতে সংশয়ভরে দেখা হলেও, পরে যুক্তরাষ্ট্র ইঙ্গিত দেয় যে “হামাস দৃশ্যপট থেকে সরলে আরব রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে গাজা শাসন ইসরায়েলের আপত্তির কারণ হবে না”। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে গাজা ফেরাতে আরব উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভাব্য সমর্থন দিতে পারে – এমন আভাস পাওয়া গেছে। তা সত্ত্বেও, ওয়াশিংটন পরিষ্কার করে দিয়েছে যে হামাসের সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ ও ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থায় তাদের সম্মতি থাকবে না। সব মিলিয়ে, যুক্তরাষ্ট্র গাজার মানবিক পুনর্গঠনে অর্থায়ন ও তদারকিতে যোগ দেবে বলে আশা, তবে তারা ইসরায়েলের নিরাপত্তা চাহিদাকেও সমান গুরুত্ব দেবে।
- অন্যান্য দেশের প্রতিক্রিয়া: গোটা বিশ্বেই গাজা যুদ্ধ ও এর পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। মুসলিম বিশ্বে তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তানসহ বহু দেশ ইসরায়েলের অভিযানকে “গণহত্যা” ও “যুদ্ধাপরাধ” বলে আখ্যায়িত করেছে এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি দৃঢ় সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে। তুরস্ক এবং ইরান কূটনৈতিক পর্যায়ে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে; কাতারকে সাথে নিয়ে তারা হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে আলোচনার সেতুবন্ধন করেছে। রাশিয়া ও চীন নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিল এবং বর্তমানে গাজার পুনর্গঠনে নিজেরা অবদান রাখার আগ্রহ দেখাচ্ছে – বিশেষ করে চীন প্রস্তাব করেছে যে তারা বড় অবকাঠামো প্রকল্পে সহায়তা করতে প্রস্তুত। লাতিন আমেরিকায় ব্রাজিল, চিলি, কলম্বিয়া ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছে; বলিভিয়া সরাসরি ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। আফ্রিকার দেশগুলোও সাধারণভাবে ফিলিস্তিনের পাশে অবস্থান নিয়েছে। এদিকে বিশ্বজনমতের চাপও নজিরবিহীন – লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, সিডনি, টোকিও থেকে শুরু করে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি বড় শহরে যুদ্ধবিরতি ও ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার দাবিতে ব্যাপক জনসমাবেশ হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘#FreePalestine’, ‘#CeasefireNow’ হ্যাশট্যাগ মিলিয়ন মিলিয়ন বার শেয়ার হয়েছে। এই জনচাপ সরকারের নীতিতেও প্রভাব ফেলেছে – অনেক নেতাকে তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে।
সংক্ষেপে, আন্তর্জাতিক সমাজ গাজার দুর্দশা মোকাবিলায় সম্পৃক্ত হচ্ছে, যদিও বড় শক্তিগুলোর ভূমিকায় এখনো পূর্ণ সমন্বয় আসেনি। জাতিসংঘ ও আরব বিশ্বের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে একটি আন্তর্জাতিক ঐক্য গড়ে উঠছে যেন গাজার পুনর্নির্মাণ ও শান্তি প্রক্রিয়া সফল হয়। তবে কার্যকর সমাধানের জন্য সবার আগে ইসরায়েলকে বাধা দেওয়ার ভূমিকা থেকে সরে এসে সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে – এটাই বিশ্বজনমতের স্পষ্ট বার্তা।
ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সমাধান: পুনর্গঠন থেকে শান্তির পথে
গাজার পুনর্গঠন সম্মেলন তাৎক্ষণিক ত্রাণ ও পুনর্নির্মাণের রূপরেখা দিলেও, দীর্ঘমেয়াদে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক সমাধান অত্যন্ত জরুরি। নিচে কয়েকটি সম্ভাব্য পথের কথা উল্লেখ করা হলো, যেগুলো ভবিষ্যতে এই সংকটের স্থায়ী সমাধানে সহায়ক হতে পারে:

- কূটনৈতিক আলোচনা পুনরায় শুরু: ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি আলোচনা বহু বছর ধরে স্থবির। বর্তমান সংকটের তীব্রতা বিশ্বের কাছে স্পষ্ট করেছে যে স্থিতিশীল শান্তি ছাড়া এ অঞ্চলে বারবার মানবিক বিপর্যয় ঘটবে। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু করতে হবে। আরব লীগ ইতোমধ্যে নিজেদের পরিকল্পনা হাজির করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রকেও আহ্বান জানানো হয়েছে এই প্রক্রিয়ায় গঠনমূলক ভূমিকা নিতে। “ওসলো” বা “মাদ্রিদ” প্রক্রিয়ার ধাঁচে হলেও নতুন পরিস্থিতির আলোকে একটি আপডেটেড শান্তি সম্মেলন আয়োজন করা যেতে পারে। জেরুজালেমের মর্যাদা, সীমান্ত নির্ধারণ, বসতি সমস্যার সমাধান, শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের অধিকার – এসব চিরায়ত ইস্যুতে ন্যায়সঙ্গত মীমাংসা করতে সব পক্ষকে টেবিলে আনতে হবে। কূটনীতির বিকল্প নেই, এবং এই সম্মেলন আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে আবারও আলোচনার প্রক্রিয়ায় শামিল হওয়ার একটি সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
- মানবিক সহায়তা ও পুনর্গঠনে গতি আনা: স্বল্পমেয়াদে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন গাজার জনগণের প্রাণ রক্ষা ও দ্রুত পুনর্বাসন। যুদ্ধবিরতি স্থায়ী না হলেও, অন্তত একটি দীর্ঘ-মেয়াদি শান্ত অবস্থা (হুডনা) বজায় রেখে অবকাঠামো মেরামত ও নির্মাণ করতে হবে। বিদ্যুৎ, পানি, হাসপাতাল, স্কুল অবকাঠামো স্থাপন অগ্রাধিকারে রেখে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দিতে হবে। বিশেষ করে শিশু ও মহিলাদের জন্য খাদ্য, ওষুধ ও মানসিক সহায়তা নিশ্চিত করা জরুরি। সীমান্ত পারাপার সহজ করা এবং অবরোধ শিথিল করতে ইসরায়েলের ওপর জোরালো আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে, ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (OIC), ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নন-অ্যালাইন্ড মুভমেন্ট সহ নানা জোটকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে দেখা যেতে পারে। আরব লীগ ও জাতিসংঘের সমন্বয়ে গঠিত একটি তদারকি বোর্ড থাকতে পারে, যারা নিয়মিত পুনর্গঠন অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করবে।
- আন্তর্জাতিক চাপ ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি: ইসরায়েল ও অন্য যে পক্ষই যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হয়েছে, তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে আন্তর্জাতিক বিচার প্রক্রিয়া জারি রাখতে হবে। আইসিসি ও আইসিজের উদ্যোগ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে – এটিকে পূর্ণতা দিতে প্রয়োজনে আরও দেশকে সহযোগিতা করতে হবে (যদিও ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির সদস্য নয়, তবে বৈশ্বিক জনমতের চাপ মামলা এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে)। একইভাবে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ও বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে নিরপেক্ষ তদন্ত চালিয়ে ঘটনার সত্য উদঘাটন এবং দোষীদের চিহ্নিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে – যেমন কিছু দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে অস্ত্র বিক্রয় ও সামরিক সহযোগিতা পুনর্বিবেচনা করছে। এই চাপ বাড়লে ইসরায়েলের নীতি পরিবর্তনে তা প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে।
- রাজনৈতিক সমঝোতা ও ফিলিস্তিনি ঐক্য: ফিলিস্তিনি ভুখণ্ডের অভ্যন্তরীণ বিভাজন (গাজায় হামাস, পশ্চিম তীরে পিএ) শান্তি ও পুনর্গঠনের পথে বড় বাধা। অতএব, একটি সর্বজনগ্রহণযোগ্য ফিলিস্তিনি জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা আবশ্যক। মাহমুদ আব্বাসের বক্তব্য অনুযায়ী নতুন নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্ব উঠে আসতে পারে, যারা হয়তো বিভক্তির রাজনীতি পেরিয়ে ঐক্যবদ্ধ লক্ষ্য নিয়ে এগোবে। হামাস ও ফাতাহ’র মধ্যে দীর্ঘদিনের বৈরিতা কাটিয়ে একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করা গেলে তা আন্তর্জাতিক মহলেও ইতিবাচক বার্তা দেবে এবং গাজা-পশ্চিম তীর উভয়ের পুনর্গঠন ও পরিচালনা সহজ হবে। আরব দেশগুলো এ ব্যাপারে মধ্যস্থতা করতে পারে – উদাহরণস্বরূপ, মিশর ও কাতার অতীতে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোকে সমঝোতায় আনতে উদ্যোগী হয়েছিল। ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হলে ইসরায়েলেরও অজুহাত কমে যাবে এবং শান্তি আলোচনায় বাস্তব অগ্রগতি সম্ভব হবে।
- দ্বিরাষ্ট্র সমাধান পুনরুজ্জীবিত করা: শেষ পর্যন্ত, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যার স্থায়ী সমাধান তখনই হবে যখন দুই independent রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে – একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন ও একটি নিরাপদ ইসরায়েল, যারা পারস্পরিক স্বীকৃতি দিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করবে। আরব লীগের সাম্প্রতিক সম্মেলনে আবার জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে তারা দ্বিরাষ্ট্র নীতিতে অটল এবং ১৯৬৭ সালের সীমানা অনুযায়ী পূর্ব জেরুজালেম রাজধানী করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই একমাত্র পথ। ২০০২ সালের আরব শান্তি পরিকল্পনাও একই কথা বলেছিল – “ভূমি উদ্ধারের বিনিময়ে স্বীকৃতি”। এখন গাজার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে সেই পরিকল্পনার নতুন প্রাসঙ্গিকতা দেখা দিয়েছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপ ও সহায়তায় ইসরায়েলকে এই পথেই আসতে বাধ্য করতে হবে, নইলে অঞ্চলটি বারবার সহিংসতার বৃত্ত থেকে বেরোতে পারবে না। দ্বিরাষ্ট্র সমাধান বাস্তবায়িত হলে গাজার পুনর্গঠনও টেকসই হবে, কারণ তখন নিশ্চিত থাকবে যে ভবিষ্যতে আর বোমাবর্ষণ বা অবরোধের শিকার হতে হবে না। ফিলিস্তিনি জনগণ নিজেদের স্বাধীন দেশে বিনিয়োগ, উন্নয়ন ও সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে। একই সাথে, ইসরায়েল তার নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কে না থেকে স্বাভাবিক প্রতিবেশী সম্পর্ক উপভোগ করতে পারবে। তাই সম্মেলনে অংশ নেওয়া সব পক্ষই দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের ব্যাপারে পুনরায় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানানো হয়েছে এই মীমাংসা বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা নিতে।
উপসংহার: গাজা পুনর্গঠনের জরুরি আরব সম্মেলন মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংকটে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় নির্দেশ করছে। দীর্ঘদিন পর আরব দেশগুলো ফিলিস্তিনের প্রশ্নে এমন সক্রিয় ও ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্য আশার সঞ্চার করছে। সম্মেলন থেকে প্রাপ্ত সিদ্ধান্তসমূহ – গাজার বাসিন্দাদের নিজ ভূমিতে রেখেই পুনর্গঠন, বিশাল তহবিল সংগ্রহ, অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন এবং দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের প্রত্যয় – যদি বাস্তবে রূপ পায়, তাহলে তা শুধু গাজার ধ্বংসাবশেষ পুনর্নির্মাণেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, পুরো অঞ্চলে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সূত্রপাত করতে পারে। অবশ্য পথটা সহজ নয়: ইসরায়েলের সহযোগিতা আদায় করা, অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুদের দুরভিসন্ধি মোকাবিলা করা, এবং বিপুল সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা – এসব চ্যালেঞ্জ জয় করতে হবে। তবুও, গাজায় যে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে তার জবাবে আরব বিশ্বের এই জাগরণ একটি আশাবাদের বার্তা দেয়। ফিলিস্তিনের মানুষ যুগের পর যুগ যে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে আসছেন, এখন হয়তো তার অবসান ঘটানোর জন্য বাস্তব পদক্ষেপ শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি সদিচ্ছা নিয়ে পাশে থাকে, তবে গাজা আবার ঘুরে দাঁড়াবে – ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে আশার নতুন সকাল নিশ্চিতই ফুটে উঠবে।