সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকার ও কুর্দিশ নেতৃত্বাধীন বাহিনী (সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস বা SDF) সম্প্রতি একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা কয়েক দশকের সংঘাত অবসানে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই চুক্তির মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার স্বায়ত্তশাসিত কুর্দিশ শাসনব্যবস্থাকে সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আওতায় আনা এবং দেশজুড়ে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ফলে ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধের পর সিরিয়ার বেশিরভাগ এলাকা কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নিচে চুক্তির শর্তাবলী, সম্ভাব্য প্রভাব, সুফল-চ্যালেঞ্জ, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা হলো।
চুক্তির মূল শর্তাবলী
- সমন্বিত শাসন ও সেনাবাহিনী: চুক্তি অনুযায়ী উত্তর ও পূর্ব সিরিয়ার স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসনের সকল বেসামরিক ও সামরিক প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এতে সীমান্ত গিরিপথ, বিমানবন্দর এবং তেল-গ্যাসক্ষেত্রগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসবে। বিশেষ করে, বর্তমানে কুর্দিশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা ইরাক ও তুরস্ক সীমান্ত পোস্টগুলো, কামিশলির বিমানবন্দর এবং তেলক্ষেত্রগুলো কেন্দ্রের অধীনে পরিচালিত হবে। এছাড়া SDF-এর প্রধান বাহিনীকে ধাপে ধাপে সিরিয়ার জাতীয় সেনাবাহিনীতে একীভূত করা হবে বলে জানানো হয়েছে। প্রায় ৯,০০০ আইসিস (ISIS) সন্দেহভাজন যোদ্ধা বন্দী রয়েছেন যেসব কারাগারে, সেগুলোকেও কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের অধীনে নিয়ে আসা হবে।
- যুদ্ধবিরতি ও নিরাপত্তা: চুক্তিটি সার্বজাতীয় যুদ্ধবিরতির কথা উল্লেখ করেছে, যা দেশজুড়ে সব ধরনের শত্রুতা বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে। এটি বাস্তবায়নের জন্য যৌথ নির্বাহী কমিটি গঠন করা হবে এবং ২০২৫ সালের শেষ নাগাদের মধ্যে চুক্তির সকল ধারা বাস্তবায়িত করার পরিকল্পনা রয়েছে। SDF বাহিনী চুক্তির অংশ হিসেবে সিরিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে অবশিষ্ট বাসার আল-আসাদ অনুগত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে সহায়তা করবে। চুক্তিতে উল্লেখ আছে যে, তারা “আসাদের অবশিষ্টাংশ ও দেশের নিরাপত্তা ও ঐক্যের সব হুমকির বিরুদ্ধে” রাষ্ট্রকে সমর্থন করবে।
- কুর্দিশ জনগোষ্ঠীর অধিকার: দীর্ঘদিন উপেক্ষিত সিরিয়ার কুর্দিশ জনগণকে প্রথমবারের মতো সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতির দফতরের ঘোষণায় বলা হয়েছে, “কুর্দি সম্প্রদায় সিরিয়ার রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ”, এবং তাদের নাগরিকত্বের অধিকার ও সংবিধানগত সকল অধিকার রাষ্ট্র দ্বারা নিশ্চিত করা হবে। এর অর্থ কুর্দিরা নিজ ভাষা ব্যবহারের ও শিক্ষার অধিকার পাবে – যে ভাষা ও সংস্কৃতি দশকের পর দশক আসাদ শাসনে নিষিদ্ধ ছিল। এছাড়া কুর্দি নববর্ষসহ নিজেদের ঐতিহ্যবাহী উৎসব উদযাপনের স্বাধীনতাও বিধিবদ্ধভাবে নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ রয়েছে। চুক্তিতে স্পষ্টভাবে “বিভেদকামী আহ্বান, ঘৃণ্য বক্তব্য ও সমাজে বিদ্বেষ ছড়ানোর প্রচেষ্টা” প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, যা জাতিগত ও ধর্মীয় সব গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য রক্ষার প্রতিশ্রুতি বহন করে।
- শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন: যুদ্ধকালীন সময়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া জনগণের ফিরে আসার ব্যাপারে চুক্তিতে অঙ্গীকার করা হয়েছে। বিশেষ করে কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চলের যে লক্ষাধিক বাস্তুচ্যুত কুর্দি নাগরিক বছর বছর ধরে শরণার্থী হিসেবে ছিলেন, তারা এই চুক্তির মাধ্যমে নিজ ভূমিতে ফিরে আসার সুযোগ ও সুরক্ষা পাবেন। সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে ফিরে আসা উদ্বাস্তুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে এবং পুনর্বাসনে সাহায্য করা হবে। অন্যদিকে, সাম্প্রতিক সহিংসতায় যে আলাওয়ি সংখ্যালঘুরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, তাদের নিরাপত্তার জন্যও পদক্ষেপ নেওয়া হবে – নতুন সরকার একটি স্বাধীন কমিটি গঠন করে উপকূলীয় অঞ্চলের সহিংসতার তদন্ত শুরু করেছে এবং দোষীদের শাস্তির আওতায় আনার আশ্বাস দিয়েছে।
সম্ভাব্য রাজনৈতিক প্রভাব
সিরিয়ার নতুন ঐক্য সরকার ও কুর্দি নেতৃত্বের এই সমঝোতা দেশটির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে:
- জাতীয় ঐক্য ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ: এ চুক্তি কার্যকর হলে সিরিয়ার প্রায় সমগ্র ভূখণ্ড অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসবে, যা দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক বিভক্তি দূর করবে। জাতীয় ঐক্যের এই নতুন ধারা দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করবে। সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিককে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ করা হবে। ফলে কুর্দিদের মতো পূর্বে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীগুলো রাষ্ট্রের মূলধারায় প্রতিনিধি ও অধিকার পেতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমদ আল-শারা এই চুক্তির মাধ্যমে দেখাতে চাচ্ছেন যে তিনি সব জাতিগোষ্ঠীর জন্য সমান অধিকারের পক্ষপাতী এবং কুর্দিদের প্রতি বৈরী নন। নতুন সংবিধান প্রণয়নের ঘোষণাও হয়েছে, যা কুর্দি স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে কিছু বিকেন্দ্রীকরণ বা ফেডারেল কাঠামো অন্তর্ভুক্ত করতে পারে বলে আলোচনা চলছে।
- আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সহযোগিতা: আসাদ সরকারকে অপসারণের পর গঠিত ইসলামপন্থী নেতৃত্বাধীন এই অন্তর্বর্তী সরকার এখনও পশ্চিমা বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সমাজ থেকে পূর্ণ স্বীকৃতি পায়নি। তবে দেশের অভ্যন্তরীণ বিভাজন কমে এলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সহযোগিতা পাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। নতুন সরকার ইতোমধ্যেই একটি জাতীয় সংলাপ সম্মেলন আয়োজন করে সংবিধান রচনার পদক্ষেপ নিয়েছে এবং সকল অস্ত্রধারী গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অধীনে আনার ঘোষণা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা পেতে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে দেশে স্থিতিশীলতা ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা নিশ্চিত করা। পশ্চিমা দেশগুলো ইতোমধ্যে সিরিয়ার ওপর থেকে যুদ্ধকালীন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে উৎসাহিত হচ্ছে, যদিও সাম্প্রতিক আলাওয়ি গণহত্যার খবর তাদেরকে উদ্বিগ্ন করে। চুক্তি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হলে সিরিয়া আন্তর্জাতিক পুনর্গঠন তহবিল, মানবিক সাহায্য ও বিনিয়োগ আকর্ষণে সক্ষম হবে।
- আঞ্চলিক রাজনীতি: তুরস্ক, ইরাক ও কুর্দি অঞ্চলসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর রাজনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে। তুরস্ক দীর্ঘদিন ধরে সিরিয়ার কুর্দি বাহিনীকে (ওয়াইপিজি/SDF) তাদের রাষ্ট্রবিরোধী PKK-এর শাখা মনে করে এসেছে এবং সিরিয়ায় সামরিক উপস্থিতি রেখেছে। এখন এই বাহিনী সিরিয়ার জাতীয় কাঠামোয় এলে তুরস্কের উদ্বেগ কিছুটা প্রশমিত হতে পারে এবং তুরস্ক–সিরিয়া সম্পর্ক উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আসাদ পতনের পর তুরস্ক নতুন সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে, ফলে চুক্তিটি আঙ্কারার কূটনীতিক সাফল্য হিসেবেও দেখা হচ্ছে। অন্যদিকে ইরাকের স্বায়ত্তশাসিত কুর্দিস্তান এই সমঝোতাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে – কুর্দি নেতা হোশিয়ার জেবারি একে “সিরিয়ার ভবিষ্যৎ গঠনে একটি মাইলফলক” বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেন এতে রাজনৈতিক অর্ন্তভুক্তি বাড়বে। সামগ্রিকভাবে, কুর্দি ইস্যুতে আঞ্চলিক বিরোধ নিষ্পত্তির একটি বিরল সুযোগ তৈরি হয়েছে; যদি তুরস্ক-পিকেকে (PKK) সংঘাতও হ্রাস পায়, পুরো অঞ্চলে শান্তির পরিবেশ জোরদার হবে।
সম্ভাব্য সামরিক প্রভাব
- একীভূত জাতীয় সেনাবাহিনী: চুক্তি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে সিরিয়ার বিচ্ছিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো একটি জাতীয় সেনাবাহিনীর আওতায় আসবে। প্রায় ১ লাখ যোদ্ধাকে ঐক্যবদ্ধ করে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনা হবে বলে প্রেসিডেন্ট শারা ঘোষণা করেছেন । SDF যোদ্ধাদের সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে; যদিও তারা চায় স্বতন্ত্র একক হিসাবে সেনাবাহিনীতে থাকতে, সরকার জানিয়েছে ব্যক্তিগতভাবে যোগ দিতে হবে। এতে শুরুতে অসন্তোষ দেখা দিলেও সময়ের সঙ্গে একটি সমন্বিত বাহিনী গঠিত হবে, যা ISIS সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বা অন্যান্য অবশিষ্ট চরমপন্থী হুমকির বিরুদ্ধে আরও কার্যকর অভিযান চালাতে পারবে। একীভূত কমান্ড কাঠামো গড়ে উঠলে দেশব্যাপী নিরাপত্তা শূন্যতা কমবে এবং অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ সহজতর হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
- কনফ্লিক্টের ইতি ও নতুন সংঘাতের ঝুঁকি: এই চুক্তির ফলে একদিকে সিরিয়ার উত্তর-পূর্বে কুর্দি বাহিনী বনাম সরকারপন্থী বাহিনীর লড়াই বন্ধ হবে (কারণ তারা এখন সহযোগী শক্তি), তেমনই দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে তুরস্ক-সমর্থিত বিদ্রোহী বনাম কুর্দি সংঘাত কমে আসবে। কেননা SDF এখন তুরস্ক-সমর্থিত সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (SNA) ও হায়াত তাহরির আল-শাম (HTS)-এর সঙ্গে একই পক্ষে আছে, অন্তত কাগজে-কলমে। তবে সমন্বয় প্রক্রিয়া নিখুঁত না হলে অন্তর্দ্বন্দ্বের ঝুঁকি রয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, কুর্দি বাহিনী অস্ত্র সমর্পণে গড়িমসি করলে বা তাদের যোদ্ধাদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ হলে নতুন সেনাবাহিনীর ভেতর দ্বন্দ্ব ছড়াতে পারে। একইভাবে, যারা এতদিন আসাদ সরকারের পক্ষে লড়েছে সেই আলাওয়ি ও অন্য যোদ্ধাদের পুরনো ক্ষোভ থাকায় তারা বিদ্রোহে জড়াতে পারে। ইতিমধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে সাবেক সরকারি সেনাদের সাথে নতুন বাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে, যা দেখিয়েছে সম্পূর্ণ সমন্বয় সাধন কতটা চ্যালেঞ্জিং। তাই সামরিকভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও অভ্যন্তরীণ সংহতি রক্ষা ও অবশিষ্ট বিদ্রোহ দমন একটি বড় পরীক্ষা হয়ে থাকবে।
- তুরস্কের সেনা উপস্থিতি ও অভিযান: তুরস্কের সেনাবাহিনী সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে মোতায়েন রয়েছে এবং তারা নিয়মিত কুর্দি নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে বিমান ও ড্রোন হামলা চালিয়ে এসেছে। এখন কুর্দি বাহিনী রাষ্ট্রীয় বাহিনীতে মিশে গেলে আঙ্কারার এই সামরিক তৎপরতার যৌক্তিকতা হ্রাস পেতে পারে। তুরস্ক পরিষ্কারভাবে বলেছে যে তারা সিরিয়ায় কুর্দি সশস্ত্র উপস্থিতি চায় না, আর এখন SDF আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেলে তুরস্ক সন্তুষ্ট হতে পারে ও হামলা কমাতে পারে। তবে তুরস্ক চাইবে, চুক্তি অনুযায়ী সত্যি সত্যি ওয়াইপিজি/পিকেকে গোষ্ঠী অস্ত্র ত্যাগ করেছে – এটি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। নতুন সিরিয়া সরকার তুরস্কের মিত্র, ফলে দুপক্ষের মধ্যে সামরিক সমন্বয় হতে পারে যাতে সীমান্তবর্তী নিরাপত্তা রক্ষা ও বাকি PKK উপদ্রব নির্মূল করা যায়। ফলে সম্ভাব্যভাবে তুরস্ক তার সৈন্য প্রত্যাহারের রোডম্যাপ নিয়ে সিরিয়ার সাথে আলোচনায় বসতে পারে যদি কুর্দি বাহিনী সফলভাবে নিয়ন্ত্রণে আসে।
- আইএস (ISIS) ও জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই: SDF এবং সরকারি বাহিনীর ঐক্যের ফলে দেশের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ISIS সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আরো সমন্বিত ও শক্তিশালী অভিযান সম্ভব হবে। SDF গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় আইএস পরাজিত করতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল। এখন জাতীয় বাহিনীতে মিশে গিয়ে সেই অভিজ্ঞতা পুরো দেশের সুরক্ষায় কাজে লাগবে। তবে সতর্কতা হিসেবে SDF কমান্ডার মাজলুম আবদি আঙ্গুল তুলে বলেছেন, যদি তুরস্ক তাদের ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে তাহলে তারা আইএস বন্দীদের নিরাপত্তা থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিতে বাধ্য হবেন, যা আইএসকে সুযোগ করে দিতে পারে। তাই নতুন পরিস্থিতিতে সব পক্ষের উচিত আইএস বিরোধী লড়াইকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেখা, যাতে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগ নিয়ে জঙ্গিগোষ্ঠীরা মাথাচাড়া না দিতে পারে।
সম্ভাব্য মানবিক প্রভাব
- যুদ্ধের সমাপ্তিতে মানবিক স্বস্তি: ২০১১ সাল থেকে চলা যুদ্ধটি সিরিয়ায় এক বিশাল মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে যেখানে আনুমানিক ৫ লক্ষের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এই শান্তি চুক্তি যদি দৃঢ়ভাবে কার্যকর হয়, তবে নতুন করে সহিংসতা কমবে এবং দেশটিতে মানবিক অবস্থা উন্নতির দিকে যেতে পারে। দীর্ঘদিন বিভক্ত সিরিয়ায় বিভিন্ন এলাকায় যে অবরোধ ও সংঘাত চলছিল, সেগুলো থেমে গেলে ত্রাণ ও পুনর্গঠন কার্যক্রম সহজ হবে। বিশেষ করে উত্তর-পূর্বের কুর্দি অঞ্চলে এতদিন আন্তর্জাতিক সহায়তা পৌঁছাতে প্রশাসনিক জটিলতা ছিল – এখন কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে আসায় বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী, রেড ক্রস ইত্যাদি সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে সেই অঞ্চলে কাজ করতে পারবে।
- বাস্তুচ্যুত মানুষের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন: চুক্তির ফলে লক্ষাধিক অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও শরণার্থীর ঘরে ফেরার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কুর্দি জনগোষ্ঠীর অনেকে তুরস্ক, ইরাক বা ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছিলেন; এখন কুর্দি অধিকারের নিশ্চয়তায় তারা ফিরে এসে পুনর্বাসিত হতে পারবেন। একইভাবে সরকার ঘোষণা করেছে যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সহ সব সম্প্রদায়ের শরণার্থীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষা করা হবে। তবে এটা একদিনে সম্ভব নয় – ফিরে আসা মানুষদের জন্য আশ্রয়, চাকরি ও সেবা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রয়োজন হবে। পশ্চিমা দেশগুলো যদি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে ও পুনর্গঠনে অর্থায়ন করে, তাহলে এসব শরণার্থীকে কর্মসংস্থান ও অবকাঠামো দিয়ে স্থায়ীভাবে স্থিতিশীল জীবনে ফিরিয়ে আনা যাবে।
- সম্প্রতি সংঘটিত সহিংসতার প্রভাব: চুক্তি স্বাক্ষরের ঠিক পূর্বে সিরিয়ার উপকূলীয় লাটাকিয়া ও তারতুস অঞ্চলে যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়েছে, তার ফলে বহু নিরীহ আলাওয়ি নাগরিক হতাহত ও বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি নতুন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর পাল্টা অভিযানে ১,০৬৮ জনের বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন বলে অনুমান করা হচ্ছে, যাদের বেশিরভাগই আলাওয়ি সংখ্যালঘু। আতঙ্কিত হয়ে প্রায় ৬,০০০ আলাওয়ি শরনার্থী সীমান্ত পেরিয়ে লেবাননের আক্কার অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় জাতিসংঘ, রেড ক্রসসহ বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থা দ্রুত ত্রাণ বিতরণ ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে তৎপর হয়েছে। নতুন সরকার ঘোষিত তদন্ত কমিটি যদি নিরপেক্ষভাবে কাজ না করে ও অভিযুক্তদের শাস্তি না দেয়, তাহলে আলাওয়ি সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থার সঙ্কট ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষোভ তৈরি হতে পারে, যা মানবিক সহ শান্তি প্রক্রিয়াকেও বিপন্ন করবে।
- আইন–শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচার: যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অস্ত্রধারীদের নিয়ন্ত্রণ ও বিচার নিশ্চিত করা একটি মানবিক প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট শারা ট্র্যানজিশনাল জাস্টিস (রূপান্তরকালীন ন্যায়বিচার) নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন – যাতে যুদ্ধাপরাধ ও নির্যাতনের শিকার পরিবারগুলো ন্যায় পায় এবং প্রতিশোধমূলক সহিংসতা এড়ানো যায়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত এটা স্পষ্ট নয় যে কীভাবে এই বিচার প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হবে। বাস্তবতা হলো নতুন সরকারের মন্ত্রিসভা ও ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীগুলোর অনেকেই (HTS, SNA, SDF ইত্যাদির কমান্ডাররা) বিগত গৃহযুদ্ধে নানাভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত ছিল। তাই স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলা কঠিন হবে, কিন্তু তা করা না গেলে ক্ষতগুলো পূরণ হবে না এবং আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক থেকে যাবে। বর্তমানে রাজধানী দামেস্কসহ কিছু এলাকায় আইন-শৃঙ্খলার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে – মুখোশধারী সশস্ত্র ব্যক্তি কর্তৃক অপহরণ ও গ্রেপ্তারের অভিযোগ উঠছে, যা সাধারণ মানুষের মনে নিরাপত্তাহীনতা বাড়াচ্ছে। এই অবস্থা কাটিয়ে ওঠা মানবিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত জরুরি।

চুক্তির সুফল
- যুদ্ধের অবসান ও জাতীয় পুনর্মিলন: এই চুক্তি সিরিয়ার দীর্ঘ সংঘাতের অবসানের পথে বড় পদক্ষেপ। কুর্দি ও আরব বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে সমঝোতা হওয়ায় দেশের ভৌগোলিক ও জাতিগত বিভক্তি কমবে। এর ফলে জাতি হিসেবে সিরিয়াবাসীর মধ্যে পুনর্মিলনের প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। সিরিয়ার নতুন নেতৃত্ব বলছে এটি “নতুন সিরিয়া গড়ার বাস্তব সুযোগ” এনে দিয়েছে। বহু বছর পর সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় পতাকার নিচে কুর্দি, আরব, সুন্নি, শিয়া, খ্রিস্টান, দ্রুজ semua গোষ্ঠী আবার একত্রিত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এই ঐক্যের অনুভূতি জাতির মনোবল পুনরুদ্ধারে সহায়ক হবে।
- কুর্দি জনগোষ্ঠীর প্রাপ্য অধিকার: চুক্তির সুফল হিসেবে কুর্দি জনগণ তাদের ন্যায্য সাংবিধানিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার লাভ করতে যাচ্ছে। তারা এখন নিজ ভাষায় শিক্ষা নিতে পারবে, নাগরিকত্বহীন প্রায় ৩ লাখ কুর্দি (যাদের আসাদ শাসন নাগরিকত্ব দেয়নি) অধিকার ফিরে পাবে, এবং স্থানীয় সরকারে তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে। আন্তর্জাতিক মহলেও এটি প্রশংসিত হচ্ছে, কেননা সিরিয়ার অখণ্ডতা বজায় রেখেই কুর্দি ইস্যুর শান্তিপূর্ণ সমাধান খোঁজা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কুর্দিদের দাবিগুলো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় মেনে নেওয়া দেশটিকে ভবিষ্যতে আরও স্থিতিশীল ও সংহত করবে।
- আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা: চুক্তির একটি অনস্বীকার্য সুফল হবে আঞ্চলিক অস্থিরতার নিরসন। তুরস্ক-পিকেকে সংঘাত ও তুরস্ক-সিরিয়া বৈরিতার মূলে ছিল সিরিয়ার কুর্দি ইস্যু। এখন সেদিকে সমাধান আসায় তুরস্ক ও সিরিয়ার সম্পর্কোন্নয়ন, সীমান্তে শান্তি এবং পিকেকে-তুরস্ক আলোচনা (বা অন্তত সংঘর্ষবিরতি) এগিয়ে যেতে পারে। বাস্তবেই কয়েক সপ্তাহ আগে জেলে বন্দী পিকেকে নেতা আবদুল্লাহ ওজালান আকস্মিকভাবে পিকেকে’কে অস্ত্র পরিত্যাগ ও ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানান, যা তুরস্কসহ প্রতিবেশীদের দ্বারা স্বাগত হয়েছে। ওজালানের ঐতিহাসিক আহ্বানের প্রায় দুই সপ্তাহের মধ্যেই এই সিরিয়া-এসডিএফ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা ইঙ্গিত দেয় বৃহত্তর কুর্দি শান্তি প্রক্রিয়ার একটি সমন্বিত ধারা চলছে। ফলে ইরাক ও ইরানের কুর্দি পরিস্থিতিতেও এর ইতিবাচক প্রতিফলন হতে পারে এবং পুরো অঞ্চলে সশস্ত্র সংঘাত হ্রাস পেতে পারে।
- সন্ত্রাস দমনে যৌথ প্রয়াস: সিরিয়ার বিভাজনজনিত দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইসলামিক স্টেট (আইএস) পুনরায় মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছিল এবং বিভিন্ন শূন্যস্থান থেকে উগ্রপন্থীরা সক্রিয় হচ্ছিল। ঐক্যবদ্ধ সিরিয়া সেনাবাহিনী ও SDF যৌথভাবে কাজ করলে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা ও সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার হবে। একইসঙ্গে ইরাক ও আন্তর্জাতিক জোটের সঙ্গেও নতুন সরকারের সমন্বয় বৃদ্ধি পাবে আইএস বিরোধী অভিযানে। এতে সিরিয়া ও পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা পরিবেশ উন্নত হবে।
- অর্থনীতি ও পুনর্গঠন: যুদ্ধ থেমে গেলে সিরিয়ার অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের দ্বার উন্মোচিত হবে। বিশেষ করে কুর্দি নিয়ন্ত্রিত তেল ও গ্যাসক্ষেত্রগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ত্বে আসায় দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এসব তেল-গ্যাস সম্পদ এবং অভ্যন্তরীণ রাজস্ব কাজে লাগিয়ে নতুন সরকার ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো পুনর্নিমাণ, বিদ্যুৎ ও পানীয় জল সরবরাহ পুনরুদ্ধার, শিক্ষা-স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান মেরামত করতে পারবে। এছাড়া কুর্দি ও অন্যান্য সংঘাতবিধ্বস্ত অঞ্চলে বিদেশি উন্নয়ন সংস্থাগুলো কাজ শুরু করতে পারবে, যদি নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। সামগ্রিকভাবে, শান্তি স্থাপিত হলে সিরিয়ার জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং অঞ্চলের বাণিজ্যিক যোগাযোগ (যেমন তুরস্ক-লেবানন তথা ইউরোপ-আরব বিশ্বের স্থলপথ) পুনরায় সচল হওয়ার সুযোগ আসবে।

চুক্তির চ্যালেঞ্জ
- বাস্তবায়ন ও বিশ্বাসযোগ্যতা: চুক্তির শর্তাবলী ঘোষণা করা যতটা সহজ, বাস্তবে মাঠপর্যায়ে তা কার্যকর করা ততটাই জটিল। এসডিএফ বাহিনী রাষ্ট্রীয় বাহিনীতে মিশতে সম্মত হলেও কীভাবে এই সংযুক্তি ঘটবে তার বিস্তারিত এখনো অস্পষ্ট। এসডিএফ চায় তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় বজায় রেখে সমন্বয় হোক, আর সরকার চায় পূর্ণ একীভবন – এই মতপার্থক্য মেটাতে যুগপৎ কমিটিগুলোকে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ তৈরী করতে হবে। এছাড়া কুর্দি স্বশাসন প্রশাসনের বেসামরিক কাঠামো (যেমন স্থানীয় কাউন্সিল, নিরাপত্তা ফোর্স আসায়েশ) রাষ্ট্রীয় মন্ত্রণালয়গুলোর অধীনস্থ করতে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন হবে। এই সমগ্র প্রক্রিয়ায় উভয় পক্ষের মধ্যে আস্থার সংকট একটি বড় বাধা – কুর্দি নেতৃত্ব আশঙ্কা করে যদি তারা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছাড়ে, ভবিষ্যতে তাদের দাবিগুলো উপেক্ষিত হতে পারে; অন্যদিকে সরকারপক্ষ সন্দেহ করে যে কুর্দিরা সত্যিই সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করবে কিনা। চুক্তিটি অনেকটাই “পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল ও অস্পষ্ট” বলে একজন বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন। সুতরাং, প্রতিটি ধাপ সতর্কতার সাথে বাস্তবায়ন ও তত্ত্বাবধান করতে হবে যাতে দুপক্ষের বিশ্বাস অটুট থাকে।
- তুরস্কের আপত্তি ও শর্ত: যদিও তুরস্ক সরাসরি এ চুক্তির পক্ষ নয়, তবে এর সফল বাস্তবায়নে আঙ্কারার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তুরস্ক প্রকাশ্যে এখনো মন্তব্য না করলেও পর্দার আড়ালে তাদের শর্ত থাকবে যে সিরিয়ায় পিকেকে/ওয়াইপিজি প্রভাব পুরোপুরি নির্মূল হতে হবে। তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থা ইতোমধ্যেই সিরিয়ার নতুন সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে এবং সেনাবাহিনীর উচ্চপদে তুরস্কঘনিষ্ঠ অফিসার নিয়োগেও ভূমিকা রেখেছে বলে জানা যাচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে, কুর্দি পক্ষের জন্য চ্যালেঞ্জ হল নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার পাশাপাশি তুরস্ককে আশ্বস্ত করা। সম্ভাব্য সমস্যা হলো – যদি তুরস্ক মনে করে চুক্তি অনুযায়ী SDF পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়নি, তারা হয়তো আবার সামরিক হস্তক্ষেপের হুমকি দেবে। অন্যদিকে কুর্দিদের শর্ত হলো তাদের সাংস্কৃতিক ও সামরিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা; তুরস্কের চাপে সরকার তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলে এসডিএফ ভেঙে পড়ে নতুন বিদ্রোহ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই তুরস্ককে সন্তুষ্ট রাখতে গিয়ে চুক্তির কুর্দিদের প্রতি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে সেটি বুমেরাং হয়ে শান্তি চুক্তিকেই বিপন্ন করতে পারে।
- আলাওয়ি ও অন্য সংখ্যালঘুদের আস্থা: আসাদ সরকারের পতনের পর নতুন শাসকগোষ্ঠী (HTS ও বিদ্রোহীরা) সুন্নি ইসলামপন্থী হওয়ায় আলাওয়ি, শিয়া, খ্রিস্টানদের মধ্যে আতঙ্ক ছিল যে তারা প্রতিহিংসার শিকার হতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত উপকূলীয় অঞ্চলের সাম্প্রতিক ঘটনার পর সেই আতঙ্ক অনেকাংশে সত্যি হয়েছে এবং আলাওয়ি জনগোষ্ঠীর আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন সরকার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে – কীভাবে আলাওয়ি ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করা যায়। যদি তারা মনে করে যে এই ইসলামপন্থী সরকার তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না, তাহলে হয় তারা স্থায়ীভাবে দেশত্যাগ করবে নতুবা গোপনে সংগঠিত হয়ে নতুন বিদ্রোহে জড়াতে পারে। ইতোমধ্যে দ্রুজ সম্প্রদায় দক্ষিণাঞ্চলে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জোট গঠনের ঘোষণা দিয়েছে (একজন সাবেক সেনা অফিসারের নেতৃত্বে), যা দেখাচ্ছে সংখ্যালঘুদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। ট্র্যানজিশনাল জাস্টিস ও ক্ষমাসূচক পদক্ষেপ গ্রহণ করে ও সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কঠোর হলে হয়তো এই আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব, কিন্তু এটি সময়সাপেক্ষ এবং জটিল কাজ।
- সাবেক আসাদপন্থী বাহিনীর অন্তর্ভুক্তি: নতুন শাসকগোষ্ঠী আসাদ সরকারের বহু সেনা ও কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছে এবং বহুজনের বিরুদ্ধে মামলা বা তদন্ত চলছে, বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধ ও দুর্নীতির অভিযোগে। এতে প্রায় ৪ লাখ পর্যন্ত “ভূতুড়ে” নাম (যারা আদতে কাজ করেনি এমন সেনা/কর্মচারী) চাকরি থেকে বাদ গেছে। যদিও কয়েকজন দক্ষ সাবেক সেনা বিশেষজ্ঞকে ফেরানো হয়েছে, তবু সহস্রাধিক আসাদপন্থী সৈনিক এখনও বেকার, অনিশ্চয়তায় ভুগছে। তাদের অনেকের বেতন বন্ধ, সরকারি বাসভবন ছেড়ে গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এই অসন্তোষ বড় আকার নিলে তা আবার সশস্ত্র বিদ্রোহে রূপ নিতে পারে – যা আংশিকভাবে উপকূলে ঘটেও গেছে। শারা সরকার এখনো এই ব্যাপারে স্পষ্ট নীতি দেয়নি; বরঞ্চ চুপ থাকা বা কঠোর মনোভাব দেখানো হয়েছে। ইরাক যুদ্ধ–পরবর্তী দেবাথিফিকেশনের ভুলের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার বলে বিশেষজ্ঞরা সাবধান করছেন। সাবেক শাসকগোষ্ঠীর সহস্র মানুষকে বাদ দিয়ে দিলে তারা “হতাশাগ্রস্ত ও রুষ্ট” হয়ে নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
- অভ্যন্তরীণ মতাদর্শিক বিভেদ: নতুন সরকারে HTS-এর ইসলামপন্থী আদর্শ, তুরস্ক-সমর্থিত SNA’র জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং কুর্দি আন্দোলনের ধর্মনিরপেক্ষ-সমাজতান্ত্রিক আদর্শ—এই তিনটি ভিন্ন মতধারা উপস্থিত থাকবে। আদর্শিক এই বৈসাদৃশ্য ভবিষ্যতে নীতি নির্ধারণ ও শাসনকাজে মতবিরোধ সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে নারীর ভূমিকা, আইনের শাসন ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ইত্যাদি ইস্যুতে। SDF যে ধর্মনিরপেক্ষ ও নারী-অধিকারসম্মত প্রশাসন রোজাভাতে চালু করেছিল, HTS সেই মডেল মানবে কিনা বা কতটা পরিবর্তন করবে তা স্পষ্ট নয়। একইভাবে বিচার ব্যবস্থায় শরিয়া আইনের ব্যাপারে HTS-এর আগ্রহ ও SDF/পশ্চিমা মডেলের দূরত্ব রয়েছে। এসব মতপার্থক্য সহজে মেটার নয় এবং ভবিষ্যতে শাসন ব্যবস্থায় চ্যালেঞ্জ এনে দিতে পারে। যদি সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংলাপ ও সংবিধানে ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান না পাওয়া যায়, তাহলে চুক্তির স্থায়িত্ব বিপন্ন হতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
শান্তি চুক্তি সম্পাদনের পর দেশ-বিদেশ থেকে নানা প্রতিক্রিয়া এসেছে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একে স্বাগত জানালেও সতর্ক নজর রাখছে:

- যুক্তরাষ্ট্র: মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও চুক্তির পর সিরিয়ার সাম্প্রতিক সহিংসতায় আলাওয়ি নাগরিক হত্যার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন এবং সিরিয়ার কর্তৃপক্ষকে এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ীদের বিচার করতে আহ্বান করেছেন। তিনি বলেছেন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার সকল ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুর পাশে আছে, এবং নতুন সরকার যদি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দায়বদ্ধ প্রশাসন গড়তে পারে তবে তারা সহায়তায় প্রস্তুত। ওয়াশিংটন চুক্তির মাধ্যমে কুর্দি বাহিনী যে সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আসছে তা সতর্ক আশাবাদ নিয়ে দেখছে, কারণ এতে আইএস বিরোধী যুদ্ধে continuity থাকবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র আগেই সাফ জানিয়েছিল, কুর্দিদের বিরুদ্ধে যে কোন প্রতিশোধ তারা মেনে নেবে না এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন হলেই সহযোগিতা প্রশ্নোত্তর হবে। এখন রুবিও’র বিবৃতি থেকে স্পষ্ট যে নতুন সরকারের ওপর চাপ থাকবে সংখ্যালঘু সুরক্ষায় গুরুতর পদক্ষেপ নেওয়ার। সামগ্রিকভাবে, যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তিকে স্বাগতই জানিয়েছে, বিশেষ করে ISIS মোকাবেলায় SDF ও দামেস্কের একীভূত প্রচেষ্টার কারণে।
- তুরস্ক: আঙ্কারা সরকার আনুষ্ঠানিক মন্তব্য না করলেও অভ্যন্তরীণভাবে এটি তুরস্কের কূটনৈতিক বিজয় বলে ধরা হচ্ছে। সিরিয়ায় তুরস্ক-সমর্থিত শক্তি ক্ষমতায় আসা এবং কুর্দি বাহিনীর নিরস্ত্রীকরণ তুরস্কের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ছিল। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ইতোমধ্যে ফেব্রুয়ারিতে দামেস্ক সফর করে প্রেসিডেন্ট শারা’র সাথে বৈঠক করেছেন এবং সিরিয়ার অখণ্ডতা রক্ষায় তুরস্কের সমর্থন জানিয়েছেন। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, তারা আশা করছে চুক্তি অনুযায়ী SDF পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী হুমকি থাকবে না। তুরস্ক প্রকাশ্যে না বললেও পেছন থেকে সিরিয়ার উপর প্রভাব রাখবে যাতে কুর্দিদের দাবিগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যদি চুক্তি সফল হয়, তুরস্ক সিরিয়ার পুনর্গঠনে বিনিয়োগ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসনে সহযোগিতা করতে আগ্রহী বলে ইঙ্গিত মিলেছে। তবে তারা সতর্ক করেছে যে পিকেকে বা সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসী তৎপরতা যদি আবার মাথাচাড়া দেয়, তবে আঙ্কারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করবে না।
- রাশিয়া ও ইরান: এই দুটি দেশ আসাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল এবং আসাদ পতন ও HTS-এর উত্থানকে বৈরাভাবে দেখেছে। রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে এই চুক্তিকে স্বাগত জানায়নি; তারা বরং দামেস্কের নতুন শাসকদের “সন্ত্রাসী” আখ্যা দিয়ে আসছে (কারণ HTS অতীতে আল-কায়েদার সঙ্গে জড়িত ছিল)। মস্কো বলছে সিরিয়ার অখণ্ডতা সমর্থন করে বটে, তবে HTS-এর মতো গোষ্ঠীর নেতৃত্বে গঠিত সরকারকে বৈধ মনে করে না। ইরানও চুক্তির প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেছে – তেহরানের মতে এটি তুরস্ক ও পশ্চিমাদের চাপে কুর্দিদের সাময়িক সমঝোতা, যা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। ইরানি রাষ্ট্রীয় মাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে যে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আসলে HTS নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি, যিনি অতীতে ইরান-সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। তেহরান উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছে, নতুন সুন্নি সরকার সিরিয়ায় ইরানের স্বার্থ ক্ষুন্ন করছে এবং লেবানন ও ইরাকেও এর প্রভাব পড়বে। তবে প্রকাশ্যে ইরান বলছে তারা সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা চায় – তাই এই চুক্তির মাধ্যমে সত্যি যদি শান্তি আসে, তারা সেটি দেখতে আগ্রহী, যদিও HTS-এর ব্যাপারে গভীর আপত্তি রয়ে গেছে।
- আঞ্চলিক দেশ ও সংস্থাগুলো: ইরাক সরকার বলেছে তারা সিরিয়ার অখণ্ডতা বজায় রাখা ও ISIS নির্মূলে সহযোগিতার যে প্রতিশ্রুতি চুক্তিতে আছে তা স্বাগত জানায়। বিশেষ করে সিরিয়ার উত্তর-পূর্বে স্থিতিশীলতা এলে ইরাকের সীমান্ত নিরাপত্তা বাড়বে। ইরাকের কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকার (KRG) এ চুক্তিকে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে নিয়েছে – কেআরজি’র সিনিয়র নেতা হোশিয়ার জেবারি একে সিরিয়ায় স্থিতিশীলতার জন্য মাইলফলক আখ্যা দিয়ে বলেছেন যে এখন আলোচনার মাধ্যমে রোজাভার স্বশাসন প্রশ্নে সমাধান খোঁজা সম্ভব। তিনি এটিকে বৃহত্তর রাজনৈতিক অর্ন্তভুক্তির দিকেও এগিয়ে যাওয়ার সংকেত হিসেবে দেখছেন। সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো রাষ্ট্রগুলো (যারা আসাদ বিরোধী বিদ্রোহীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল) সতর্ক আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। তারা এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, “সিরিয়ায় সম্প্রতি যে সমঝোতা হয়েছে তা স্বাগতযোগ্য; আমরা আশা করি এটি সিরিয়ার জনগণের কষ্ট লাঘব করবে এবং একটি রাজনৈতিক সমাধানের পথ সুগম করবে” – একইসঙ্গে তারা সকল পক্ষকে মানবাধিকার রক্ষার আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব একটি বিবৃতিতে বলেছেন, “সিরিয়ায় সংঘাতের অবসান ও একটি সর্বসম্মত শান্তি চুক্তি দেখতে পাওয়া আশা জাগানিয়া। জাতিসংঘ এই প্রক্রিয়ায় সহায়ক ভূমিকা নিতে প্রস্তুত এবং সিরিয়ার পুনর্গঠনে বিশ্ব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছে।” ইউরোপীয় ইউনিয়নও একে স্বাগত জানিয়েছে, তবে তারা সিরিয়ায় যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠনের উপর জোর দিয়ে বলেছে যে এসব শর্ত পূরণ হলে ধীরে ধীরে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও সহযোগিতা বাড়ানো হবে।
- আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকার গোষ্ঠী: রেড ক্রস ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (UNHCR) চুক্তির যুদ্ধবিরতি ধারাকে স্বাগত জানিয়েছে, কারণ এতে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর নিরাপত্তা বাড়বে এবং উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তনের পথ খুলবে। তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে চুক্তির পর HTS-এর মতো গোষ্ঠী ক্ষমতায় আসায় মানবাধিকার পরিস্থিতি নজরদারিতে রাখতে হবে। তারা বিশেষত সাম্প্রতিক আলাওয়ি হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত এবং কুর্দি অধ্যুষিত এলাকায় পূর্বে ঘটে যাওয়া যে কোনো যুদ্ধাপরাধের জবাবদিহিতা চেয়েছে। এই গোষ্ঠীগুলো বলছে, চুক্তি তখনই দীর্ঘস্থায়ী শান্তি দেবে যদি সব পক্ষ অতীতের নির্যাতন ও বৈষম্যের পুনরাবৃত্তি না করে এবং একটি মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল শাসন প্রতিষ্ঠা করে।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
বিশেষজ্ঞরা এই শান্তি চুক্তিকে সিরিয়ার প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিক ঘটনা বলে আখ্যা দিচ্ছেন, তবে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে নানা বিশ্লেষণ করছেন:

- অ্যারন লুন্ড (Century International থিঙ্কট্যাঙ্ক): লুন্ডের মতে চুক্তিটি সুচিন্তিত হলেও এর বিবরণ বেশ অস্পষ্ট এবং অনেক কিছু পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে। তিনি মনে করেন অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট শারা এটির মাধ্যমে সংখ্যালঘু বিশেষ করে কুর্দিদের প্রতি সদয় মনোভাব প্রদর্শনের সুযোগ পেলেও এর সাফল্য নির্ভর করবে কতটা বাস্তবে তাদের অধিকার রক্ষা হয় তার ওপর। লুন্ড আরও বলেন, SDF এই চুক্তিকে নিজেদের জন্য বিমা হিসেবে দেখছে – বিশেষ করে যদি আকস্মিকভাবে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ঘটে (ধরি ট্রাম্প প্রশাসন আবার সেই উদ্যোগ নিল), তাহলে দামেস্কের সাথে সমঝোতা কুর্দিদের টিকে থাকার পথ হবে। তবে তিনি সতর্ক করেছেন, চুক্তি বাস্তবায়নে দেরি হলে বা বারবার ঝুলে গেলে উভয় পক্ষের চরমপন্থীরা ফের যুদ্ধের পথ বেছে নিতে পারে।
- চ্যাথাম হাউস বিশ্লেষণ: আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউস একটি বিশদ প্রতিবেদনে জানিয়েছে, নতুন সিরিয়া সরকারকে জাতীয় সেনাবাহিনী গড়তে বেশ সমস্যার মুখে পড়তে হবে। তুরস্কের প্রত্যক্ষ মদদে HTS এখন ক্ষমতায় এসেছে এবং তারা সামরিক একীকরণে তাড়াহুড়া করছে, কিন্তু এতে ছোট বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো উপেক্ষিত বোধ করছে। প্রতিবেদনে একজন SNA কমান্ডারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, “ছোট গোষ্ঠীগুলোকে তো গোনায়ই ধরা হচ্ছে না, কেবল বড় দলগুলোকে তুষ্ট করার চেষ্টা হচ্ছে”। এতে অনেকে সরকারের প্রতি অবিশ্বাসী থেকে যাচ্ছেন এবং অস্ত্র জমা দিতে নারাজ, কারণ তারা ভয় পাচ্ছে শেষে হয়ত তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হবে বা একেবারে পাশ কাটানো হবে। বিশেষত SDF শুরুতে সংলাপ বয়কটও করেছিল স্বায়ত্তশাসন রক্ষার দাবিতে। চ্যাথাম হাউস উল্লেখ করছে, তুরস্ক নিজেও চায় SDF-এর স্বতন্ত্র কাঠামো বিলুপ্ত হোক এবং তাদের অনেক যোদ্ধার বেতন এখনো তুরস্ক বহন করছে বলে জানা গেছে। এ পরিস্থিতিতে HTS নেতৃত্ব দ্বিধাবিভক্ত – কেউ কেউ চায় কুর্দিদের ওপর সামরিক চাপ বাড়িয়ে আত্মসমর্পণ করাতে, আবার কেউ মনে করে যদি আমেরিকা সমর্থন প্রত্যাহার করে তবে কুর্দিরা এমনিতেই মেনে নেবে। সারসংক্ষেপে, চ্যাথাম হাউসের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে চুক্তি একটি শুভ সূচনা, কিন্তু পরিকল্পিত কাঠামো না থাকায় সেনাবাহিনী ও শাসন গঠনে ভুলভ্রান্তি হলে আবার সংঘাত জাগতে পারে। তারা দ্রুত একটি রূপান্তরকালীন ন্যায়বিচার কাউন্সিল গঠনের পরামর্শ দিয়েছে যাতে সব পক্ষের অপরাধ ও অভিযোগ মোকাবেলা করে আস্থা তৈরি হয়।
- হোশিয়ার জেবারি (ইরাকি কুর্দি রাজনীতিক): ইরাকের প্রখ্যাত কুর্দি নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোশিয়ার জেবারি এই চুক্তিকে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক হিসেবে দেখছেন। তিনি X (সাবেক টুইটার) পোস্টে বলেছেন, এই সমঝোতা সিরিয়ায় বৃহত্তর রাজনৈতিক অর্ন্তভুক্তির দরজা খুলেছে এবং রোজাভার স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে আলোচনার ভিত্তি রচনা করেছে। জেবারি উল্লেখ করেন, SDF ধীরে ধীরে সিরিয়ার নিরাপত্তা কাঠামোয় একীভূত হলেও একটি শক্তিশালী বাহিনী হিসাবে বিদ্যমান থাকবে, অর্থাৎ কুর্দিদের প্রতিরক্ষা ক্ষমতা একবারে বিলীন হবে না বরং যৌথ কাঠামোয় রূপ নেবে। এটি কুর্দি জনগণের জন্য আশাব্যঞ্জক বার্তা যে তারা বিপদাপন্ন হবে না। জেবারির দৃষ্টিতে, সংলাপ ও যৌথ কমিটির মাধ্যমে রোজাভার স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা decades ধরে অসমাধানযোগ্য ছিল। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও তিনি একে মঙ্গলজনক বলে আখ্যা দিয়েছেন।
- স্থানীয় সিরীয় পর্যবেক্ষক ও নাগরিকরা: সিরিয়ার ভেতরে বসবাসরত অনেকে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন সংঘাতের পরিসমাপ্তি দেখতে পেয়ে, তবে কিছু মানুষ বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এখনো আশঙ্কায় আছে। এক দামেস্কবাসী বলেছেন, “আমরা জানি না কাকে বিশ্বাস করব। সশস্ত্র নিরাপত্তাকর্মীরা রাস্তায় টহল দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ নেই…আইনশৃঙ্খলা শূন্য, কেউ আমাদের রক্ষা করছে না”। এই মন্তব্য উদ্ধৃত করে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রাজধানী ও বিভিন্ন এলাকায় নিরাপত্তা শূন্যতা ও বিশৃঙ্খলা এখনো বড় সমস্যা। তাই সাধারণ নাগরিক পর্যায়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করতে হবে, নইলে জনগণের আস্থা অর্জন কঠিন হবে। যুদ্ধবিদীর্ণ সিরিয়ায় বহু ব্যক্তি এখনও ন্যায়বিচার ও স্বাভাবিক জীবনের প্রত্যাশায় দিন গুনছেন – তাদের মতে, এই চুক্তি তাত্ত্বিকভাবে ভালো হলেও বাস্তবে দেখতে চান যে গ্রেফতার, গুম, নিপীড়ন বন্ধ হয়েছে এবং সবাই স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও মতপ্রকাশ করতে পারছে।
- মিডল ইস্ট বিশেষজ্ঞরাঃ অনেক মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক মনে করেন, এই চুক্তি কুর্দি সমস্যা সমাধানের এক নতুন মডেল হিসেবে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে। কার্নেগি এন্ডাওমেন্টের এক গবেষক লিখেছেন, তুরস্ক ও কুর্দি বিদ্রোহীরা যদি সিরিয়া মডেল থেকে শিক্ষা নিয়ে আলোচনায় বসে, পুরো অঞ্চলে শান্তির নতুন যুগ শুরু হতে পারে । তবে একই সঙ্গে তিনি সতর্ক করেছেন যে সিরিয়ার ক্ষেত্রে অনন্য পরিস্থিতি ছিল – আসাদের পতন, HTS-এর উত্থান এবং আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্য – যা অন্যত্র নাও মিলতে পারে। ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের এক বিশ্লেষক বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ছিল আগে থেকেই তুরস্ক–পিকেকে ও সিরিয়া–কুর্দি দুই ইস্যুতে মধ্যস্থতা করে রাখা, তাহলে এত রক্তপাত ছাড়াই সমাধান দ্রুত আসত। তারপরও বর্তমানে তিনি মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র যদি এই চুক্তিকে সমর্থন ও পর্যবেক্ষণ করে, তাহলে SDF ও নতুন সিরিয়া সরকারের মধ্যে সুস্থ সম্পর্ক তৈরি হবে যা ভবিষ্যতে সিরিয়ায় মার্কিন স্বার্থ (সন্ত্রাস দমন, স্থিতিশীলতা) রক্ষা করবে।
সংক্ষেপে, বিশেষজ্ঞ মহল এই চুক্তিকে সময়োপযোগী পদক্ষেপ বলে স্বাগত জানাচ্ছে, কিন্তু সেই সাথে বাস্তবায়নের সূক্ষ্ম দিকগুলো ঠিকমতো সম্পন্ন করার ব্যাপারে পরামর্শ ও সতর্কতাও প্রদান করছে।
উপসংহার
পিকেকে-সংকটের প্রেক্ষাপটে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকার ও কুর্দি নেতৃত্বের মাঝে স্বাক্ষরিত এই শান্তি চুক্তি যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় নতুন আশার সঞ্চার করেছে। এর মূল শর্তগুলো – রাজনৈতিক ও সামরিক সংহতি প্রতিষ্ঠা, কুর্দি অধিকার স্বীকার, এবং জাতিগত-ধর্মীয় অন্তর্ভুক্তি – যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়, তবে সিরিয়ার জন্য এটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ হয়ে উঠবে। চুক্তির ইতিবাচক দিক হলো এটি দেশটিকে বিভেদের গভীর খাদ থেকে টেনে তুলতে পারে এবং আঞ্চলিক শান্তি ও সহযোগিতার পথ তৈরি করতে পারে। তবে বিপরীত দিকে চ্যালেঞ্জও কম নয় – বিশেষ করে আস্থা গড়া, প্রতিশোধ এড়ানো, বহুপক্ষীয় সেনাবাহিনী গঠন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কাজগুলো খুবই জটিল ও সময়সাপেক্ষ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সতর্ক সমর্থন এবং নজরদারি এই প্রক্রিয়াকে সাহায্য করতে পারে।
পরিস্থিতি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে সিরিয়ার জনগণ যুদ্ধের ক্লান্তি থেকে মুক্তি চায় এবং একটি নতুন অধ্যায় শুরু করতে প্রস্তুত। শান্তি চুক্তিটি সেই নতুন অধ্যায়ের ভিত্তিপ্রস্তর সরবরাহ করেছে। এখন প্রয়োজন সকল সংশ্লিষ্ট পক্ষের নিষ্ঠা ও উদারতা, যাতে এই চুক্তির প্রতিটি ধারা বাস্তবে রূপ পায় এবং সিরিয়া সত্যিকার অর্থে পুনর্গঠনের পথে এগিয়ে যায়। ভবিষ্যৎ কয়েক মাস খুব গুরুত্বপূর্ণ – এই সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের চাপা আগুন নিভে গিয়ে শান্তি ও পুনর্জন্মের আলোকবর্তিকা জ্বলে উঠতে পারে। সকলের দৃষ্টি এখন সিরিয়ার ঐক্যবদ্ধ জনপদ ও নেতৃত্বের দিকে – তারা কি ইতিহাসের এই মোড়ে স্থায়ী শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, নাকি পুরনো অবিশ্বাস ও বিরোধিতা আবারও সামনে আসবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে আজকের বাস্তবতা হলো, শান্তির সম্ভাবনা হাতের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এবং সঠিক সিদ্ধান্তগুলোর মাধ্যমেই সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব।