সাম্প্রতিক সংঘাতের প্রেক্ষাপট
দীর্ঘদিনের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিরোধ ২০২৩ সালের শেষভাগে এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ে পৌঁছে। ৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলে আকস্মিক আক্রমণ চালায়, যাতে প্রায় ১,২০০ মানুষ নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি জিম্মি হন। এর জবাবে ইসরায়েল অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে। টানা বিমান হামলা ও স্থল আক্রমণে গাজার ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় এবং মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে। যুদ্ধের মাত্র প্রথম তিন মাসেই হাজার হাজার ফিলিস্তিনি প্রাণ হারান, যাদের উল্লেখযোগ্য অংশ শিশুসহ সাধারণ নাগরিক। অবরোধের কারণে খাদ্য, পানি, জ্বালানিসহ জরুরি সরবরাহ বন্ধ থাকায় পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটে।
১৫ মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে এক যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এই সময়কালে ধারণা করা হয় গাজায় ৭০,০০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং ইসরায়েলেও প্রায় এক হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে মৃতদের উল্লেখযোগ্য অংশ নারী ও শিশু, অসংখ্য পরিবার একাধিক সদস্যকে হারিয়েছে এবং বহু পরিবারের সবাই নিশ্চিন্ন হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এই প্রাণহানিকে সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পশ্চিমা দেশগুলো শুরুতে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের ওপর জোর দিলেও, বেসামরিক হতাহত বাড়তে থাকায় বিশ্বজনমতে ক্ষোভ ও উদ্বেগ বৃদ্ধি পায়। এই প্রেক্ষাপটে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে, কেননা যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতা ও মানবিক আর্তনাদ বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা এবং তা ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব তাদের ওপরই বর্তায়।
পশ্চিমা মিডিয়ার ইসরায়েলপন্থী বর্ণনা ও এর পেছনের কারণ
ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ চলাকালীন পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যমের খবর পরিবেশনা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অনেক বিশ্লেষকের মতে পশ্চিমা মিডিয়ার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শুরু থেকেই ইসরায়েলের পক্ষপাতমূলক বর্ণনা তুলে ধরেছে এবং ফিলিস্তিনের বিষয়ে প্রান্তিক অবস্থায় রয়ে গেছে। সংবাদ কাভারেজে হামাসের হামলা ও ইসরায়েলি ক্ষয়ক্ষতির বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে সামনে আনা হলেও, একই সময়ে গাজায় ঘটে চলা ব্যাপক মানবিক বিপর্যয় ও সাধারণ মানুষের দুর্দশা তুলনামূলকভাবে অনেক কম গুরুত্ব পেয়েছে। একাধিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পশ্চিমা গণমাধ্যমের অনেক প্রতিবেদনই একপেশে যা ইসরায়েলি সূত্র ও বক্তব্য অপ্রতুল – যাচাই বাচাই ছাড়াই প্রচার করা হয়েছে, বিপরীতে ফিলিস্তিনি পক্ষের দৃশ্যপট প্রায় অনুপস্থিত বা উপেক্ষিত থেকে গেছে। বলা হয়ে থাকে যে সংবাদমূল্যের বিচারেও পশ্চিমা মিডিয়া ইসরায়েলকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং ফিলিস্তিনির প্রেক্ষাপট বা ভূমিকাগুলো সবসময় পেছনের সারিতে ঠেলে দিয়েছে।

পশ্চিমা মিডিয়ার এই ইসরায়েলপন্থী ঝোঁকের পেছনে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র ও বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশের সরকারগুলো দীর্ঘদিন থেকেই কূটনৈতিকভাবে ইসরায়েলের মিত্র; ফলস্বরূপ তাদের গণমাধ্যমেও সেই নীতিগত অভিমুখ প্রতিফলিত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, পশ্চিমা বিশ্ব ইসরায়েলকে সবসময় নিজেদের মতো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখে, যে পাশ্চাত্য মূল্যবোধ ধারণ করে। ফলে স্বাভাবিকভাবে অনেক পশ্চিমা সাংবাদিক ও সম্পাদক ইসরায়েলি জনমতের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকেন এবং ফিলিস্তিনিদের অবস্থান অবচেতনে উপেক্ষা করেন। দ্বিতীয়ত, ইসরায়েল-পন্থী শক্তিশালী লবিগুলোর বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক প্রভাব রয়েছে যা মিডিয়ার বর্ণনাকে প্রভাবিত করে। যেমন, এন্টি-ডিফেমেশন লীগ (AdL) ও আমেরিকান-ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (AIPAC) -এর মতো প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলের সমালোচকদের বিরুদ্ধে দ্রুত “বামপন্থী বা ইহুদীবিদ্বেষী তকমা দেওয়ার জন্য পরিচিত। তাদের সংগঠিত প্রচারণা ও চাপ অনেক সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকে আত্মসেন্সরশিপে উৎসাহিত করে, যাতে প্রতিবেদনগুলোতে ইসরায়েলের সমালোচনা সীমিত থাকে। এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে এমন লাগাতার চাপ ও হুমকির পরিবেশে অনেক সাংবাদিক, যারা ব্যক্তিগতভাবে ভারসাম্যপূর্ণ রিপোর্ট করতে চাইতেন, তারাও নিরপেক্ষতা হারিয়ে প্রতিষ্ঠানগত পক্ষপাতের সাথে মানিয়ে নিতে বাধ্য হন।
এছাড়া ঐতিহাসিক কারণও রয়েছে: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও হলোকাস্টের স্মৃতি পশ্চিমা সমাজে ইহুদিদের নিরাপত্তা ও স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে একটি সংবেদনশীলতা তৈরি করেছে। জার্মানি ও ইউরোপের কিছু দেশে ইসরায়েলের প্রতি ঐতিহাসিক ঋণবোধ কাজ করে বলে সেখানকার মিডিয়া ইসরায়েল-বিষয়ে অতিরিক্ত সতর্ক এবং সমর্থনমূলক অবস্থান নেয়। ফলস্বরূপ, ইসরায়েলি সামরিক পদক্ষেপের সমালোচনা অনেক সময়েই অতিরঞ্জিত বা পক্ষপাতদুষ্ট বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়, আর ফিলিস্তিনিদের অভিযোগগুলো গুরুত্ব পায় না। কথা হচ্ছে, পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের এই পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভংগী নতুন কিছু নয় –- গবেষণা বলছে দশকের পর দশক ধরেই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে পশ্চিমা রিপোর্টিংয়ে এক ধরণের গভীর-প্রোথিত পক্ষপাত দেখা গেছে। সাম্প্রতিক গাজা যুদ্ধ সেই পুরনো প্রবণতাকেই আবারও নগ্নভাবে প্রকাশ করেছে।
মানবিক দৃষ্টিকোণঃ যুদ্ধের ফলাফল ও ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠ
গাজার সাধারণ মানুষের জন্য ২০২৩-২৪ সালের যুদ্ধ ছিল এক অভূতপূর্ব মানবিক বিপর্যয়। কিন্তু পশ্চিমা মূলধারার অনেক গণমাধ্যমে এই মানবিক দৃষ্টিকোণটি তুলনামূলকভাবে অনুপস্থিত ছিল বলে সমালোচকরা উল্লেখ করেছেন। ইসরায়েলি হামলায় আহত বা নিহত প্রতিটি ইসরায়েলির ব্যক্তিগত গল্প পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হলেও, বিপরীতে হাজার হাজার নিহত ফিলিস্তিনির কষ্টের কণ্ঠস্বর পাওয়া গেছে খুব কমই। বহু সময় দেখা গেছে শিরোনামে বা প্রতিবেদনেও ফিলিস্তিনি হতাহতদের বিষয়ে নৈর্ব্যক্তিক সংখ্যা উল্লেখ ছাড়া অন্য কোনো বিস্তারিত নেই, কিংবা তাদের মৃত্যুটা কার হাতে ঘটেছে সে বিষয়টি অস্পষ্ট থেকে গেছে। ভাষাগত দিক থেকেও এক ধরনের অমানবিকরণের অভিযোগ ওঠে – যেমন অনেক পশ্চিমা প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুকে জাষ্ট দে ডায়েড বা পালেস্টিনিয়ানস ডায়েড জাতীয় বাক্যে প্যাসিভ ভয়েসে উপস্থাপন করা হয়েছে, ফলে কে হত্যা করল তা স্পষ্ট না হয়ে মৃত্যুটা যেন স্বয়ংক্রিয় ঘটনা বলে ভেসে ওঠে। ভাষাতত্ত্ববিদদের মতে, মিডিয়ার এই ভাষা নির্বাচন সচেতন বা অসচেতনভাবে এমনভাবে গড়ে ওঠে যাতে গাজায় সংঘটিত অপরাধগুলো ধামাচাপা পড়ে এবং ইসরায়েলি অবস্থান শক্তিশালী থাকে। অন্যদিকে ইসরায়েলিদের প্রসঙ্গে প্রয়োগিত ভাষা অনেক বেশি মানবিক ও সক্রিয়, যেমন “ইসরায়েলি শিশু হত্যায় হামাসের নৃশংসতা” এমন শব্দচয়ন ঘটনা সম্পর্কে পরিষ্কার বার্তা দেয়, কিন্তু গাজায় শিশুরা মারা গেছে বললে কার্যত হত্যাকারীকে আড়াল করা হয়।

পশ্চিমা মিডিয়ার কাভারেজে ফিলিস্তিনি জনগণের নিজ কণ্ঠ প্রায় শোনা যায়নি বললেই চলে, বরং তাদের ছবি ও বর্ণনা প্রায়শঃ তৃতীয়পক্ষের (ইসরায়েলি বা আন্তর্জাতিক) দৃষ্টিকোণ থেকে উঠে এসেছে। উদাহরণস্বরূপ, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যখন নিহতের সংখ্যা জানায়, অনেক পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম সেটি “হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে” বলে তাচ্ছিল্য করে প্রচার করেছে, যেনো তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। বিপরীতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর তথ্যগুলো কম-বেশি যাচাই বাছাই ছাড়াই শিরোনামে এসেছে। ফলাফল – গাজার ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা ও প্রতিবাদ পশ্চিমা প্রচারে পরিপূর্ণ মাত্রায় প্রতিফলিত হয়নি। বহু পশ্চিমা সংবাদকক্ষে নিজের প্রতিষ্ঠানের এই আচরণে অসন্তুষ্ট সাংবাদিকরাও মুখ খোলেছে কিন্ত তাতে চাকুরি খোয়ানো ছাড়া তেমন কোনো লাভ হয়নি। ২০২৩ সালের শেষ দিকে ১,৫০০-এর বেশি সাংবাদিক একটি খোলা চিঠিতে পশ্চিমা মিডিয়ার কাভারেজের নিন্দা করেন এবং অভিযোগ করেন যে সংবাদকক্ষগুলো “ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে অমানবিক ভাষা ব্যবহার করে যে বর্ণনা দিচ্ছে তা মূলত তাদের জাতিগত নির্মূলকে ন্যায্যতা দেওয়ার কাজে লেগেছে” এবং “ফিলিস্তিনি, আরব ও মুসলিম মতামতকে গুরুত্বহীন করে দেখানো হয়েছে”। এমনকি ব্রিটিশ রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারক বিবিসির নিজস্ব আটজন সাংবাদিক প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছেন যে বিবিসি গাজা সংঘাত কভারেজে নিরপেক্ষতা রক্ষা করতে ব্যর্থ – সেখানে “ইসরায়েলি ভুক্তভোগীদের মানবিকভাবে উপস্থাপনে যতটা যত্ন দেখানো হয়েছে, ফিলিস্তিনি ভুক্তভোগীদের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি, এবং ঐতিহাসিক পটভূমিও উপেক্ষিত হয়েছে”। এই ধরনের বক্তব্য পশ্চিমা গণমাধ্যমের ভেতরেই আত্মসমালোচনার ইঙ্গিত দেয় যা প্রমাণ করে যে সমস্যা বাস্তব ও উপলব্ধি-যোগ্য।
আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হল, গাজা যুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিকতার নীতি ও নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংঘাত এলাকায় তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে ইসরায়েল সরকার বিদেশি সাংবাদিকদের গতিবিধিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। গাজার ভেতরে যেসব গুটিকয়েক আন্তর্জাতিক সাংবাদিক খবর সংগ্রহ করছিলেন, তাদের ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর এসকর্ট ছাড়া চলাচল নিষিদ্ধ করা হয় এবং সংগ্রহ করা ভিডিও/ছবি প্রচারের আগে সেন্সর বিভাগের অনুমোদন নিতে বাধ্য করা হয়। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ইসরায়েলের সর্বোচ্চ আদালতও এই সামরিক সেন্সরের সিদ্ধান্তকে নিরাপত্তার যুক্তিতে বহাল রাখে। স্বাভাবিকভাবেই, এমন পরিবেশে গাজার মাটিতে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের অনেকাংশ বিশ্ববাসীর অজানাই থেকে গেছে বা ফিল্টার হয়ে পৌঁছেছে। তদুপরি, গাজার যুদ্ধ হচ্ছে সাংবাদিকদের জন্য স্মরণকালের অন্যতম প্রাণঘাতী সংঘাত। সংবাদ পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর তথ্যমতে ২০২৩-২৪ সালে ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধে দু’শতাধিক সাংবাদিক ও মিডিয়াকর্মী নিহত হয়েছেন, যাদের বিপুল সংখ্যকই ফিলিস্তিনি। যুদ্ধের প্রথম ১০ সপ্তাহেই ৭৭ জন সাংবাদিক নিহত হন, এদের মধ্যে ৭২ জন ছিলেন ফিলিস্তিনি। ফিলিস্তিনের ঘটনাবলী মাঠ পর্যায় থেকে কভার করতে গিয়েই মূলত তারা প্রাণ হারিয়েছেন। এত সংখ্যক স্থানীয় সাংবাদিকের মৃত্যু মানে বিশ্বের গণমাধ্যমের সামনে প্রত্যক্ষ তথ্যপ্রাপ্তির রাস্তা আরও সংকুচিত হয়ে যাওয়া। এইসব কারণ মিলিয়ে পশ্চিমা দর্শক-শ্রোতারা হয়তো গাজার জনগণের কষ্টের পূর্ণ চিত্রটি পাননি, বরং একটি দূরবর্তী পরিসংখ্যান কিংবা বিরোধপূর্ণ দাবির গল্প হিসেবেই তা জেনেছেন।
সাংবাদিকতার নীতি ও পশ্চিমা মিডিয়ার দ্বৈত মানদণ্ড
পশ্চিমা গণমাধ্যম নিজেদের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার মানদণ্ডের জন্য গর্ব করে থাকে। কিন্তু ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে তাঁদের অবস্থান মূল্যায়ন করলে নানা দ্বৈত মানদণ্ড চোখে পড়ে বলে বিশ্লেষকদের মত। যে নীতিগুলো অন্য প্রসঙ্গে দৃঢ়ভাবে প্রয়োগ করা হয়, এখানে তা শিথিল বা পরিবর্তিত হয়ে যায়। যেমন, রাশিয়া যখন ইউক্রেনে আক্রমণ চালায়, তখন পশ্চিমা মিডিয়া সরাসরি সেই আগ্রাসনকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছে, বেসামরিক ইউক্রেনীয়দের দুর্দশাকে কেন্দ্র করে গল্প প্রকাশ করেছে এবং হামলাকে “যুদ্ধাপরাধ” অথবা “নির্লজ্জ আগ্রাসন” বলে অভিহিত করেছে। কিন্তু ইসরায়েল কর্তৃক গাজায় চালানো বিবিধ ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষেত্রে অনেক মূলধারার পশ্চিমা গণমাধ্যম তুলনামূলক নরম পরিভাষা ব্যবহার করেছে এবং সচরাচর “আত্মরক্ষা”, “বাধ্যতামূলক প্রতিক্রিয়া” ইত্যাদি ফ্রেমওয়ার্কে বিষয়টি উপস্থাপন করেছে। একটি গবেষণাতে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের শীর্ষ সংবাদমাধ্যম গত এক বছরে গাজার ঘটনা কোনোভাবেই “গণহত্যা” বা “genocide” শব্দটি ব্যবহার করে বর্ণনা করেনি, বরং তাদের সরকারগুলোর ইসরায়েলকে উদ্দেশ্য করে করা হালকা সমালোচনামূলক মন্তব্যগুলোই শুধু প্রতিধ্বনিত করেছে – যা মূলত পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর এই সংঘাতে পরোক্ষ সম্পৃক্ততাকে আড়াল করে দেয়। এই প্রবণতাকে বিশ্লেষকেরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের “বাহিরের লোক দিয়ে অন্যের হাতে অত্যাচার চালানো” কৌশলের সাথে তুলনা করেছেন, যেখানে মুখে নিন্দা জানিয়ে আসলে বড় শক্তিগুলো নিজেদের মিত্রের কঠোর কার্যক্রমকে প্রশ্রয় দেয়।

সংবাদ উপস্থাপনের ভিন্ন মানদণ্ডের আরেকটি উদাহরণ উঠে এসেছে সাম্প্রতিক এক মিডিয়া বিশ্লেষণে। দ্য নেশন পত্রিকার এক বিশেষ গবেষণায় সিএনএন এবং এমএসএনবিসি চ্যানেলের গাজা যুদ্ধ কাভারেজে গুরুতর অসামঞ্জস্য ধরা পড়েছে। প্রথম ১০০ দিনে এই দুটি মার্কিন চ্যানেলে যে পরিমাণ মানবিক সহানুভূতিশীল কাভারেজ দেওয়া হয়েছে, তার সিংহভাগই ছিল ইসরায়েলি ভুক্তভোগী (৭ অক্টোবর হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত) ও ইউক্রেনীয় যুদ্ধপীড়িতদের গল্পে; অথচ সেই তুলনায় ফিলিস্তিনি সাধারণ মানুষের করুণ অবস্থা খুবই কম গুরুত্ব পেয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে যে ঐ সময়ে ফিলিস্তিনি বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা ইউক্রেনের বেসামরিক মৃত্যুর চেয়ে ৫০০% বেশি ছিল, তবু পশ্চিমা ওই চ্যানেলগুলোতে খবরের আলোয় ফিলিস্তিনিদের অবস্থার প্রতিফলন ছিল না বললেই চলে। এই বৈষম্যকে স্পষ্টতই “ডাবল স্ট্যান্ডার্ড” বা দ্বৈত নীতিমালা হিসেবে দেখা হচ্ছে, যেখানে ভুক্তভোগীর জাতিগত/জাতীয় পরিচয় অনুযায়ী সহমর্মিতার মাত্রা ওঠানামা করে। শুধু টেলিভিশন নয়, প্রিন্ট মিডিয়াতেও এর নজির রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস গাজার জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরে এক ইসরায়েলি হামলায় একসঙ্গে ছয় শিশু নিহত হওয়ার সংবাদটি প্রথম প্যারাগ্রাফে উল্লেখ না করে নীচে লুকিয়ে রেখেছিল এবং একই সঙ্গে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অজুহাত – যে “সন্ত্রাসীরা আবাসিক এলাকায় অস্ত্র মজুদ করছিল” – সেটিও যোগ করেছিল। পরবর্তীতে যদিও ইসরায়েল নিজেই স্বীকার করে যে ঐ শিশুগুলো তাদের বোমাতেই নিহত হয়েছিল, পশ্চিমা মূলধারার কোনো কোনো পত্রিকার সে বিষয়ে আগ্রহ বা গুরুত্ব ততটা দেখা যায়নি। এই ঘটনার মতো আরও উদাহরণে দেখা গেছে যে, যেসব সংবাদ প্রতিষ্ঠান নিজেদের নির্ভুলতা ও ভারসাম্যের ওপর গর্ব করে, তারাই মাঝে মাঝে ফিলিস্তিনি পক্ষের তথ্য বা মানবিক ট্র্যাজেডিগুলোকে উপেক্ষা বা হালকাভাবে প্রকাশ করে যাচ্ছে।
পশ্চিমা গণমাধ্যমের দ্বিমুখী আচরণ শুধু খবরের উপস্থাপনাতেই নয়, অভ্যন্তরীণ নীতিতেও প্রতিফলিত হয়েছে। কিছু কিছু সংবাদমাধ্যমে সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও ইস্যুটির উপর নির্ভর করে ভিন্নতা পেয়েছে। যেমন, ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেওয়ার কারণে বা একটি মুক্ত চিঠিতে স্বাক্ষর করার কারণে কয়েকজন সাংবাদিককে তাঁদের প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বরখাস্ত বা দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে – যা স্বাধীন সাংবাদিকতার সাথে সাংঘর্ষিক বলে অনেকে মনে করেন। ২০২৩ সালের শেষ দিকে লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস পত্রিকা তার কিছু প্রতিবেদককে গাজা যুদ্ধ কভারেজ থেকে সরিয়ে দেয় শুধু এই কারণে যে তারা পশ্চিমা মিডিয়ার পক্ষপাত নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে একটি চিঠিতে সই করেছিলেন। আবার, একই সময়ে হামাস কর্তৃক ইসরায়েলি বন্দীদের মুক্তি সংক্রান্ত একটি ভিডিওতে মানবিক আবেগ দেখানোয় সিএনএনের এক মুসলিম প্রযোজককে চাকরিচ্যুত করা হয় বলে খবর বেরিয়েছিল। এসব ঘটনাবলী ইঙ্গিত করে যে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে মিডিয়ার ভেতরেও মতবিভেদ ও চাপ কাজ করছে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সব মতের জন্য সমানভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুযায়ী মতানৈক্য থাকা স্বাভাবিক, তবে দ্বৈত মানদণ্ডের প্রয়োগ সাংবাদিকতা পেশার নৈতিকতা ও বিশ্বস্ততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
বিকল্প মিডিয়া, সামাজিক প্ল্যাটফর্ম ও সত্যের সন্ধান
প্রধানধারার পশ্চিমা মিডিয়া যখন তথ্য ও বর্ণনায় পক্ষপাত ও শূন্যতা রাখছিল, তখন অনেক পাঠক-দর্শক বিকল্প উৎস ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দিকে ঝুঁকেছেন সত্যের অধিকতর পূর্ণচিত্র পেতে। বর্তমান যুগে ফেসবুক, টুইটার (বর্তমান “এক্স”), ইনস্টাগ্রাম, টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো যে কোনো সংকটের সময়ে নাগরিক সাংবাদিকতা ও বিকল্প কথন ছড়িয়ে দেওয়ার শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। গাজার যুদ্ধও তার ব্যতিক্রম নয়। মূলধারার কাভারেজের ফাঁকগুলো সামাজিক মাধ্যম পূরণ করতে শুরু করে – especially ground-level footage, প্রত্যক্ষদর্শীদের লাইভ বর্ণনা, এবং গাজার মানুষের ব্যক্তিগত গল্পগুলো এসব প্ল্যাটফর্মে ভাইরাল হতে থাকে। যুদ্ধের প্রতিটি দিন #FreePalestine, #GazaUnderAttack ইত্যাদি হ্যাশট্যাগে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ গাজার পরিস্থিতি শেয়ার করেছেন। সাধারণ বাসিন্দাদের মোবাইল ফোনে ধারণ করা ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িঘর, আহত শিশু ও অসহায় পরিবারের হৃদয়বিদারক ছবি-ভিডিওগুলো মূলধারার টিভি বা পত্রিকায় জায়গা না পেলেও, অনলাইনে কোটি কোটি মানুষ দেখেছে। উদাহরণস্বরুপ, লন্ডন, নিউইয়র্কসহ পশ্চিমা বড় শহরগুলোতে অনুষ্ঠিত ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভগুলোর দৃশ্য ও বার্তা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক ছড়িয়েছে, যা পশ্চিমা টিভিতে তুলনামূলক কম প্রচার পেয়েছিল। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব এবং উন্নয়নশীল দেশের নেটিজেনরা সোচ্চারভাবে ফিলিস্তিনের পক্ষে মতামত জানাতে থাকেন অনলাইনে। একটি বিশ্লেষণে তো দেখা গেছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ইনস্টাগ্রাম ও টিকটক মিলিয়ে ফিলিস্তিনপন্থী পোস্ট ও কন্টেন্টের সংখ্যা ইসরায়েলপন্থী কন্টেন্টের তুলনায় বহুগুণ বেশি ছিল – হিসাব অনুযায়ী ওই মাসে প্রায় ১০৯.৬১ বিলিয়ন পোস্ট ফিলিস্তিনের পক্ষে প্রকাশিত হয়, বিপরীতে ৭.৩৯ বিলিয়ন পোস্ট ইসরায়েলের পক্ষে। এই বিপুল অনলাইন জনমত মূলধারার গণমাধ্যমকে চাপের মুখে ফেলেছে এবং অনেক তরুণ দর্শক-পাঠক টিভি বা সংবাদপত্রের বদলে সরাসরি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে খবর নিচ্ছেন।

মূলধারার বাইরে বিকল্প মিডিয়া ও স্বাধীন সাংবাদিকরাও সংঘাতের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আল জাজিরা, মিডল ইস্ট আই, ডেমোক্র্যাসি নাউ কিংবা দ্য ইন্টারসেপ্ট-এর মতো আন্তর্জাতিক বিকল্প গণমাধ্যমগুলো শুরু থেকেই গাজার পরিস্থিতি, প্রতিক্রিয়া, পটভূমি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর গুরুত্বের সাথে প্রচার করেছে। আল জাজিরা তো গাজার ভেতর থেকে সরাসরি সম্প্রচার চালিয়ে গেছে, যদিও তাদের নিজের সাংবাদিক পরিবারসহ নিহত হয়েছে এবং একপর্যায়ে ইসরায়েল তাদেরকে নিষিদ্ধ করেছে। সামাজিক মাধ্যমে স্থানীয় গাজার সাংবাদিক ও অ্যাকটিভিস্টরা বিশ্ববাসীর কাছে সরাসরি নিজেদের দুর্দশার কথা পৌঁছে দিয়েছেন লাইভ ভিডিও, টেক্সট আপডেট ও ছবির মাধ্যমে। অনেক সময় তাদের দেওয়া তথ্যই পরে বড় সংবাদমাধ্যমে খবর আকারে প্রকাশিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গাজার চিকিৎসকরা হাসপাতালগুলোতে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি চলছে তা টুইটারের মাধ্যমে বিশ্বকে জানাতে থাকেন, যার ফলে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হয় এবং মূলধারার মিডিয়াও সে খবর কভার করতে বাধ্য হয়েছে। সামাজিক মাধ্যম শুধু তথ্য দেওয়া নয়, মানবিক সংহতি ও আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রেখেছে। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া গাজার বাস্তব দৃশ্যগুলি বিশ্বজুড়ে জনমতকে নাড়া দেয়, যার ফলস্বরূপ লন্ডন, সিডনি, নিউইয়র্ক, ঢাকা সহ বিভিন্ন শহরে ব্যাপক জনসমাবেশ ও প্রতিবাদ হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারণা থেকেই অনেক মানুষ পিটিশন সই করা, ত্রাণ সংস্থায় অনুদান দেওয়া, এমনকি রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।
যদিও সোশ্যাল মিডিয়া তথ্য বিতরণের বিকল্প রাস্তা খুলেছে, তবে সেখানে ভুল তথ্য ও প্রোপাগান্ডাও প্রচুর ছড়িয়েছে, যা আলাদা উদ্বেগের বিষয়। কিছু প্রযুক্তি কোম্পানির বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনপন্থী কনটেন্ট সেন্সর করার অভিযোগও উঠেছে। তারপরও সামগ্রিক বিচারে বলা যায় যে বর্তমান তথ্যযুগে সত্য পুরোপুরি চাপা রাখা অসম্ভব। একদিকে মূলধারার অনেক মিডিয়া গাজার যুদ্ধের খবর যথাযথভাবে না দিতে পারলেও বিকল্প উপায়ে সেই খবর ও গল্পগুলি বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গেছে। পশ্চিমা দেশগুলোর তরুণ প্রজন্ম টিকটক-ইনস্টাগ্রামের ভিডিও, টেলিগ্রামের আপডেট কিংবা টুইটারের থ্রেড পড়ে গাজায় আসলেই কী ঘটছে সে সম্পর্কে ধারণা পেয়েছে, যা আগের যুগে বড় সংবাদমাধ্যমগুলোর ফিল্টারের বাইরে পাওয়া কঠিন ছিল। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক জনমতের চাপে পড়ে ধীরে ধীরে কিছু পশ্চিমা মূলধারার মিডিয়াতেও স্বরে পরিবর্তন আসছে – হয়তো সামান্য, তবে লক্ষণীয়। যেমন ডিসেম্বর ২০২৩-এ নিউইয়র্ক টাইমস তাদের প্রতিবেদনে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উল্লেখকে “হামাসের দাবি” না বলে সরাসরি তথ্যসূত্র হিসেবে মেনে নিয়েছে, যা পূর্ববর্তী বর্ণনার তুলনায় কিছুটা ভারসাম্যের লক্ষণ। এটি ইঙ্গিত করে যে বিকল্প মাধ্যম ও সামাজিক প্ল্যাটফর্মসমূহ আজ সত্য উদঘাটনে এবং প্রচারে এক নতুন পথ দেখাচ্ছে, যা মূলধারার গণমাধ্যমকেও জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে এসেছে।
উপসংহার
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত ঘিরে পশ্চিমা মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে এই পর্যালোচনা থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে সংবাদমাধ্যম কেবল নিরপেক্ষ বাস্তব চিত্র উপস্থাপক নয় – তাদের বর্ণনা রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব দ্বারা পরিচালিত হতে পারে। সাম্প্রতিক গাজা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পশ্চিমা মূলধারার অনেক মিডিয়া ইসরায়েলপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে সমালোচনার মুখে পড়েছে। এর ফলে ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্দশা ও মতামত প্রাপ্য জায়গা পায়নি এবং সাংবাদিকতার নীতিগত মানদণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তবে একই সঙ্গে আশা জাগানিয়া ব্যাপার হল যে বিকল্প গণমাধ্যম, নির্ভীক সাংবাদিক ও সাধারণ নাগরিকরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সেই শূন্যতা অনেকাংশে পূরণ করার চেষ্টা করেছেন। মূলধারার প্রচারের বাইরে সমান্তরাল এক সত্যের ধারাবিবরণী বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে।
পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর আত্মসমালোচনা ও সংশোধনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। সংবাদকর্মীদের উচিত দ্বন্দ্বাঞ্চলে উভয় পক্ষের মানবিক কণ্ঠসমূহ সমানভাবে তুলে ধরা, সব তথ্যকে একই স্ক্রুটিনিতে ফেলা এবং ভাষা ও ফ্রেমের ক্ষেত্রে গোপন পক্ষপাত এড়ানো। অন্যদিকে দর্শক-শ্রোতাদেরও সচেতনভাবে বহুমাত্রিক উৎস থেকে খবর সংগ্রহ করা বাঞ্ছনীয়, যাতে পুরো চিত্রটি বোঝা যায়। গণমাধ্যমের দ্বৈত মানদণ্ড দূর করে সত্যনিষ্ঠ ও মানবিক সাংবাদিকতা নিশ্চিত করা শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াতেও এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পশ্চিমা গণমাধ্যম যদি সত্যিই তাদের ঘোষিত নীতিতে অবিচল থাকে, তবে তাদের উচিত হবে সব সংঘাতে একই মানদণ্ডে আওয়াজ তোলা – নিপীড়িতের পক্ষে জোরালো কথা বলা, চাক্ষুষ সত্যকে যথাযথভাবে তুলে ধরা, এবং যেকোনো পক্ষের অন্যায়কে সমান তীব্রতায় প্রশ্ন করা। ভবিষ্যতে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে গণমাধ্যমের ভূমিকায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে – এমনটি কায়মনোবাক্যে প্রত্যাশা করা যায় – যাতে ন্যায়বিচার ও মানবিকতা কোনও ভৌগোলিক বা রাজনৈতিক সীমারেখায় আবদ্ধ না থাকে।