সংক্ষিপ্ত পটভূমি:
নিউইয়র্ক সিটির কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধ ঘিরে গত বসন্তে প্রো-প্যালেস্টাইন ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। শিক্ষার্থীরা দক্ষিণ লনে তাঁবু গেড়ে “গাজা সংহতি” আন্দোলন চালায় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ভবন দখল করে ইজরায়েলের সাথে জড়িত কোম্পানিগুলো থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের দাবি তোলে। কিছু ইহুদি শিক্ষার্থী এসব প্রতিবাদের পরিবেশে হয়রানির শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাসে “বৃদ্ধিমান্ধপূর্ণ ইহুদিবিদ্বেষ” (অ্যান্টিসেমিটিজম) দমনে ব্যর্থতার অভিযোগ তোলে এবং শাস্তিস্বরূপ কলম্বিয়ার প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার ফেডারেল অনুদান বাতিল করে দেয়। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে ঐ আন্দোলনের সাথে জড়িত এক প্রাক্তন ছাত্রকে গ্রেফতারের ঘটনাও বিশ্ববিদ্যালয়টিকে নিয়মিত সংবাদ শিরোনামে রেখেছে।
ফেডারেল হস্তক্ষেপ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি পরিবর্তন
ট্রাম্প প্রশাসন কলম্বিয়াকে একপ্রকার আলটিমেটাম জারি করে বলে, ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলা ও ঘৃণা রোধে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ না নিলে সরকারি তহবিল পুরোপুরি বন্ধ হবে। ১৩ মার্চ তারিখের এক ফেডারেল পত্রে শিক্ষা বিভাগ (Department of Education), স্বাস্থ্য ও মানব পরিষেবা বিভাগ এবং জেনারেল সার্ভিসেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন যৌথভাবে বেশ কিছু দাবির তালিকা দেয়। এতে উল্লেখ ছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়টি “মৌলিকভাবে আমেরিকান শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের ইহুদিবিদ্বেষী সহিংসতা ও হয়রানি থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে”। ফেডারেল কর্তৃপক্ষের ভাষায়, যে বিশ্ববিদ্যালয় করদাতাদের বিপুল অর্থ পায় তাদের “প্রাপ্য অর্থের যথাযথ ব্যবহারে দায়িত্বশীল হতে হবে” ।
ঐ পত্রে কলম্বিয়ার মিডল ইস্ট, সাউথ এশিয়ান অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ বিভাগকে পাঁচ বছরের জন্য “অ্যাকাডেমিক রিসিভারশিপ”-এর অধীনে আনার দাবি জানানো হয়, যাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ওই বিভাগের কার্যক্রম সরাসরি নজরদারিতে নিতে পারে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়কে বেশ কিছু নীতিগত পরিবর্তনের নির্দেশ দেয়া হয়, যেমন: গত বসন্তের ক্যাম্পাস দখল ও অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার বা বহুবছরের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করা; ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে একটি নতুন সুস্পষ্ট সংজ্ঞা ও নীতি প্রণয়ন; স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ভর্তি ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ফেডারেল আইন ও নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য আনানো; এবং ক্যাম্পাস সিকিউরিটি গার্ডদের পূর্ণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ক্ষমতা প্রদান। ফেডারেল চিঠিতে আরো বলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্যাম্পাসে পরিচয় গোপন করতে মুখোশ পরা নিষিদ্ধ করতে হবে (ধর্মীয় ও স্বাস্থ্যজনিত কারণ ছাড়া) এবং অশনাক্ত বা বেআইনি সংগঠনের সহায়তাকারী ছাত্রসংগঠনগুলোকে কঠোর পর্যবেক্ষণে এনে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এক কথায়, ট্রাম্প প্রশাসন কলম্বিয়ার ছাত্র-আন্দোলন দমনে কঠোর শৃঙ্খলা ও নজরদারি ব্যবস্থা চায়।
প্রথমে কলম্বিয়া কর্তৃপক্ষ এই দাবিগুলো পর্যালোচনা করার কথা বললেও, বিপুল তহবিল হারানোর চাপের মুখে তাদের নীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি ক্যাটরিনা আর্মস্ট্রং এক মেমোতে জানান যে কিছু ফেডারেল দাবির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ক্যাম্পাস সিকিউরিটি শক্তিশালী করতে নতুন করে তিন ডজন সশস্ত্র ক্যাম্পাস পুলিশ নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যাদের শিক্ষার্থী গ্রেফতারের ক্ষমতা থাকবে। তাছাড়া, এখন থেকে বিক্ষোভ বা জমায়েতের সময় কেউ মুখোশ পরলে কর্তৃপক্ষ চাইলে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় আইডি দেখাতে বাধ্য থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডল ইস্ট স্টাডিজ ও প্যালেস্টাইন স্টাডিজ সেন্টার-এর উপরও একজন জ্যেষ্ঠ উপ-প্রভোস্ট নিয়োগ করে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফেডারেলের মোট ৯ দফা দাবির মধ্যে মাস্ক নিষিদ্ধকরণ, শৃঙ্খলা বিষয়ক চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে কেন্দ্রীভূত করা, এবং ক্যাম্পাস পুলিশ দিয়ে “অরাজকতা সৃষ্টিকারী”দের গ্রেফতারের সুযোগ নিশ্চিত করার মত শর্তগুলোও ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এক বিবৃতিতে বলছে, “প্রত্যেক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মীর জন্য ক্যাম্পাসকে নিরাপদ ও সকলের জন্য স্বাগতযোগ্য করার অংশ হিসেবেই” এসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে অনেকের মতে, এই নীতিগত পরিবর্তন আদতে ফেডারেল চাপে মাথা নত করার নামান্তর এবং এর মাধ্যমে প্রশাসনিক স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়েছে।
শিক্ষার্থী গ্রেফতার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকট
ফেডারেল চাপের সবচেয়ে বিতর্কিত পদক্ষেপ হল প্রাক্তন কলম্বিয়া ছাত্র এবং আন্দোলন নেতা মাহমুদ খালিল-এর গ্রেফতার। ৮ মার্চ রাতে খালিল ও তাঁর গর্ভবতী স্ত্রী যখন বিশ্ববিদ্যালয় হাউজিং-এর বাসায় ফিরছিলেন, তখন হঠাৎই ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (ICE)-এর এজেন্টরা তাঁকে আটক করে নিয়ে যায়। খালিল সিরিয়া থেকে আগত একজন গ্রিন কার্ডধারী বৈধ স্থায়ী বাসিন্দা এবং কলম্বিয়ায় স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করেছেন। গ্রেফতারের মুহূর্তে তাঁর স্ত্রী তার স্থায়ী বাসিন্দার কার্ড (গ্রিন কার্ড) দেখিয়েও কর্মকর্তাদের থামাতে পারেননি। ট্রাম্প সরাসরি এই গ্রেপ্তারের প্রশংসা করে খালিলকে “প্রো-হামাস” সমর্থক বলে আখ্যায়িত করেন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় এটিকে “এটাই প্রথম গ্রেফতার, আরও অনেক বাকি” ধরনের বার্তা দেন। খালিলের বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযোগ, তিনি নাকি ক্যাম্পাসে হামাসপন্থী তৎপরতার নেতৃত্ব দিয়েছেন – যদিও তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কিত কোনও অপরাধের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ বা মামলা নেই।
খালিলের গ্রেফতারের পেছনে যে আইনি যুক্তি দেখানো হয়েছে তা নাগরিক স্বাধীনতা সংগঠনগুলোর কাছে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ (DHS) দাবী করেছে খালিল “এক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী (হামাস)-এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মকাণ্ডের” নেতৃত্ব। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ ধরণের অভিযোগ অত্যন্ত ঝাপসা এবং বাস্তব অপরাধের আইনি মানদণ্ড পূরণ করে না। মার্কিন আইন অনুযায়ী কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হলে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে “বস্তুগত সহায়তা” দেয়ার প্রমাণ লাগবে, যা এখানে অনুপস্থিত। তাই এই ব্যাপক সংজ্ঞার অপব্যবহার ভবিষ্যতে যে কোনও সরকার সমালোচক বা নীতিবিরোধীকেই “বিদেশনীতি বিপজ্জনক” আখ্যা দিয়ে টার্গেট করতে পারে বলে আইনজ্ঞদের শঙ্কা। একজন নাগরিক স্বাধীনতা বিশেষজ্ঞ উইল ক্রিলি (FIRE সংস্থার আইন পরিচালক) সতর্ক করে বলেন, “সরকারের সাম্প্রতিক বাক্যবাণী শুনে দেশের মানুষ এখন সরকার বা ইজরায়েল সরকারের সমালোচনা করতে আগে দুইবার ভাববে – এই ভীতিচাপ দমনমূলক পরিবেশই সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক”।
গ্রেফতারের পর খালিলকে সরাসরি নিউইয়র্ক থেকে হাজার মাইল দূরের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের একটি অভিবাসী আটক কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয় – যা তাঁর আইনজীবী ও পরিবারের কাছে পৌঁছানো কঠিন করে তুলেছে । খালিলের দ্রুত অন্তঃবর্তীকালীন মুক্তির দাবিতে নিউইয়র্কে আদালতের বাইরে ও ক্যাম্পাসে শত শত মানুষ বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন। ফেডারেল বিচারক আপাতত তাঁর নির্বাসনাদেশ স্থগিত করেছেন এবং তাঁকে লুইজিয়ানা থেকে নিউইয়র্কে ফিরিয়ে আনার আবেদন বিবেচনা করছেন। সমালোচকদের মতে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদে অংশ নেয়া মাত্রেই একজন বৈধ স্থায়ী বাসিন্দাকে “সন্ত্রাসী সহানুভূতিশীল” তকমা দিয়ে এভাবে আটক রাখা যুক্তরাষ্ট্রের আইনি রীতিনীতির পরিপন্থী এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর হুমকি স্বরূপ। একজন এCLU আইনজীবী ব্রেট কাউফমান মন্তব্য করেছেন, “রাষ্ট্র এর মাধ্যমে জনগণকে তাদের রাজনৈতিক মতের কারণে কারাগারে পুরছে – মতের কোনও ব্যাপার না, এ দৃশ্য সমস্ত নাগরিকের জন্য ভীতিকর হওয়া উচিত”। অনেকের চোখে, এটি এক প্রকার নজিরবিহীন পদক্ষেপ যা যুক্তরাষ্ট্রে আকাডেমিক স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারকে ঠান্ডা করতে পারে।
বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া এবং সমালোচনা
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ফেডারেল হস্তক্ষেপ ও খালিলের গ্রেফতারের ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক, অধিকার কর্মী ও শিক্ষার্থী এটিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর আঘাত এবং শিক্ষাঙ্গনে সরকারি নিপীড়নের উদাহরণ হিসাবে বর্ণনা করছেন।
কলম্বিয়ারই ইহুদি অধ্যাপক মেরিয়ানা হিরশ সতর্ক করেছেন যে, প্রশাসনের যা পদক্ষেপ, তা আসলে ইহুদিদের সুরক্ষা নয় বরং মতপ্রকাশ নিয়ন্ত্রণই আসল উদ্দেশ্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তিনি বলেন, “কলম্বিয়াকে ইহুদিবিদ্বেষের আখড়া বলে যেসব মিথ্যা পরিচিতি দেয়া হয়েছে, তা রিপাবলিকান প্রতিষ্ঠান এবং ট্রাম্প প্রশাসনের আসল উদ্দেশ্য – কথা বলা, প্রতিবাদ এবং সমগ্র উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ – চাপিয়ে দেওয়ার অজুহাত”। জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক নাদার হাশেমি একই সুরে আল জাজিরাকে জানান যে, “ইহুদিবিদ্বেষ দমন নিঃসন্দেহে মহৎ লক্ষ্য, কিন্তু এই নীতিকে আড়াল করে আসলে প্যালেস্টাইনপন্থী মতকে দাবিয়ে দেয়ার কাজ হচ্ছে… মূলত যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনি মানবাধিকারপন্থী সকল মত প্রকাশকেই চুপ করানোই টার্গেট”।
মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা সংগঠনগুলোও এসব ঘটনার নিন্দা করেছে। জে স্ট্রিট নামের এক ইহুদী অধিকার সংগঠনের সভাপতি জেরেমি বেন-আমি সরাসরি বলেছেন, ট্রাম্প প্রশাসন ইহুদিদের নিরাপত্তার ভয়কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে গণতান্ত্রিক আদর্শ ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে আক্রমণ করছে। তাঁর কথায়, ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে প্রকৃত উদ্বেগকে এইভাবে অপব্যবহার করা অত্যন্ত বেদনাদায়ক, এবং এতে “নাগরিক অধিকার থেকে অভিবাসন ও উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত” গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নিউইয়র্ক সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (NYCLU) একে ম্যাকার্থির যুগের মত গণ-সেন্সরশিপের চেষ্টা বলে আখ্যা দিয়ে বলেছে: “ট্রাম্প প্রশাসন যে পন্থায় কলেজগুলোকে চাপে ফেলে রাষ্ট্রের পছন্দ না হওয়া বক্তব্য – যেমন ইজরায়েল সমালোচনা বা ফিলিস্তিনের অধিকারের পক্ষে কথা – বন্ধ করাতে চাইছে, এটি চরম বিপজ্জনক নিপীড়নের নতুন স্তর”।
এর পাশাপাশি, মার্কিন কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাট সদস্যরাও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমালোচনা করছেন। তারা খালিলের গ্রেফতারের ঘটনার তুলনা করেছেন স্বৈরাচারী পুলিশের রাষ্ট্রের কাণ্ডকারখানার সঙ্গে এবং বলেছেন এটি দ্বিমত পোষণকে অপরাধীকরণের শামিল। নাগরিক অধিকার সংস্থা ACLU মন্তব্য করেছে যে রাজনৈতিক ভিন্নমত দমন করতে এই ধরনের নির্বিচার গ্রেফতার-নির্বাসন এক নজিরবিহীন পদক্ষেপ, যা আমেরিকার সংবিধান-স্বীকৃত স্বাধীনতার ওপর হামলা। অন্যদিকে, অনেকে একে যুক্তরাষ্ট্রে রেড স্কেয়ারের পর সবচেয়ে বড় বাকস্বাধীনতা সংকট বলেও বর্ণনা করেছেন। এসব কড়া প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে ট্রাম্প প্রশাসন অবশ্য নিজেদের অবস্থান থেকে সরেনি; বরং তারা যুক্তি দিচ্ছে যে ক্যাম্পাসে ইহুদিবিদ্বেষ ও চরমপন্থী কার্যকলাপ রুখতেই এমন পদক্ষেপ জরুরি।
উল্লেখযোগ্যভাবে, কলম্বিয়ার যেসব প্রো-প্যালেস্টাইন বিক্ষোভ সংগঠক দল (যেমন “কলম্বিয়া অ্যাপারথাইড ডাইভেস্ট”) রয়েছে, তাদের মধ্যেও ইহুদি শিক্ষার্থীরা আছেন এবং তারাও এই আন্দোলনের অংশ। এর মানে, পুরো প্রতিবাদ-আন্দোলনটিকে এককথায় ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ বলে দাগিয়ে দেওয়া জটিল ও বিভ্রান্তিকর। সমালোচকদের ভাষায়, প্রশাসন ইচ্ছে করেই বৈধ রাজনৈতিক প্রতিবাদকে চরমপন্থার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছে। ফলস্বরূপ, আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে সংখ্যালঘু মতের অধিকারীরা এখন আতঙ্কিত যে যেকোনো সময় তাদের ভিসা বা স্থায়ী অধিকার কেড়ে নিয়ে “রাষ্ট্রের শত্রু” তকমা দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হতে পারে।
উচ্চশিক্ষা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর প্রভাব
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে চলমান এই টানাপড়েন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর ফেডারেল হস্তক্ষেপের সামাজিক ও নৈতিক প্রভাব নিয়ে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। সমালোচকদের ধারণা, এই দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করে ট্রাম্প প্রশাসন ভবিষ্যতে যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করাতে সহজতর পথ পেয়ে গেল। ইতোমধ্যেই ট্রাম্প প্রশাসন আরও বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে – হার্ভার্ড, ইয়েল থেকে শুরু করে প্রায় ৬০টি কলেজকে জানানো হয়েছে ক্যাম্পাসে ইহুদিবিদ্বেষ মোকাবিলায় পদক্ষেপ না নিলে তাদের ফেডারেল অর্থায়ন ঝুঁকিতে পড়বে। এমনকি ভিন্ন ইস্যুতেও হস্তক্ষেপ দেখা যাচ্ছে: উদাহরণস্বরূপ পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির ট্রান্সজgender ক্রীড়াবিদ নীতির কারণে ১৭৫ মিলিয়ন ডলারের তহবিল সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে। সমালোচকদের প্রশ্ন – সরকারের এই নিপীড়নমূলক আচরণ কি এক নতুন দৃষ্টান্ত, যেখানে প্রশাসনের মতের বিরোধিতা করলেই একাডেমিক স্বাধীনতা বিপন্ন হবে?
অনেকে আশঙ্কা করছেন, এভাবে ফেডারেল চাপের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি তাদের নিজস্ব নীতি ও মতপ্রকাশের পরিবেশ গড়ে রাখার ক্ষমতা হারায়, তবে তা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ডেকে আনবে। বিশ্ববিদ্যালয় সবসময় মতের বৈচিত্র্য, বিতর্ক এবং সত্য অন্বেষণের স্থান। যদি রাজনৈতিক প্রভাবে অসন্তুষ্টিকর মতাবলম্বীদের বহিষ্কার বা চুপ করানোর চল শুরু হয়, তবে সৃজনশীল চিন্তা ও মুক্ত আলোচনার পরিবেশ বিনষ্ট হবে। ট্রাম্প প্রশাসনের শিক্ষা নীতিতে এমনকি পুরো শিক্ষা বিভাগটি বিলুপ্ত করার কথাও উঠে আসছে – যা উচ্চশিক্ষার ফেডারেল সহযোগিতা ও তদারকির ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তায় ফেলেছে। এতে করে একদিকে যেমন শিক্ষাঙ্গনে স্বাধিকার ও স্বশাসনের প্রশ্ন জোরালো হয়েছে, অন্যদিকে বিদেশি ও সংখ্যালঘু ছাত্রদের মনে ভয় ঢুকে গেছে যে প্রতিবাদ মানেই অপরাধী হয়ে যাওয়া।
অন্যদিকে, প্রশাসনের সমর্থকরা বলছেন যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করদাতাদের টাকায় চলে, তাই সেখানে কারও জন্য ঘৃণামূলক আচরণ বা সহিংসতা বরদাস্ত করা যায় না। তাদের মতে, কলম্বিয়ার ঘটনাগুলো ইহুদি ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি শত্রুতাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করেছিল, যা বন্ধ করা জরুরি ছিল। এই যুক্তিতে ফেডারেল সরকার ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলা ও সুরক্ষা ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা নিচ্ছে মাত্র। তবে সমালোচকরা প্রশ্ন করেন, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা আর বৈধ মতকে দমন করার মধ্যে সীমারেখা টানবে কে? সরকারি নিয়ন্ত্রণ কতদূর বৈধ আর কোথায় স্বাধীন শিক্ষালয়ের নীতিতে হস্তক্ষেপ শুরু হয়ে যায় – এই বিতর্কের মীমাংসা সহজ নয়।
উপসংহার
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি ও ট্রাম্প প্রশাসনের এই বিরোধ কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নয়, বরং আমেরিকার সামগ্রিক একাডেমিক স্বাধীনতা, ক্যাম্পাসের অধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন তোলে। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সত্যিই সবধরনের বৈষম্য ও বিদ্বেষ থেকে ছাত্রছাত্রীদের সুরক্ষা দিতে হবে, অন্যদিকে ছাত্রদের মতপ্রকাশ ও প্রতিবাদের অধিকারও রক্ষা করতে হবে। এই দুই উদ্দেশ্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই চ্যালেঞ্জ।
কলম্বিয়ার ঘটনাবলী ভবিষ্যতে একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে থেকে যাবে: প্রশাসনিক চাপে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় নতি স্বীকার করলে তার কী পরিণতি হয়, আর গণতান্ত্রিক সমাজে নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য নীতি-নির্ধারকদের কী ভূমিকা নেয়া উচিত। এ অবস্থায় শিক্ষাঙ্গন, সরকার ও নাগরিক সমাজকে মিলে ভাবতে হবে – কীভাবে মতের ভিন্নতা ও বিতর্ককে সম্মান জানিয়ে সত্যিকারের নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ক্যাম্পাস তৈরি করা যায়। আজকের সিদ্ধান্তগুলোই নির্ধারণ করবে, আগামী দিনে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাধীন চিন্তার আলো জ্বালিয়ে যেতে পারবে কিনা, নাকি রাজনৈতিক চাপের অন্ধকারে সেই আলো ম্লান হয়ে যাবে।