নেপাল, হিমালয়ের কোলে অবস্থিত এই দেশটি বর্তমানে তীব্র রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি। ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন, দলীয় কোন্দল, এবং বৈদেশিক হস্তক্ষেপের সমন্বিত প্রভাবে দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা হুমকির সম্মুখীন। চলুন জেনে নেওয়া যাক এই অস্থিরতার পেছনের প্রধান কারণগুলো কি কি:

রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি ও সহিংসতা

নেপালে ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু গোষ্ঠী রাজতন্ত্র পুনর্বহালের দাবি জানিয়ে আন্দোলন করছে। ২৮ মার্চ ২০২৫ তারিখে কাঠমান্ডুতে এক সমাবেশে রাজতন্ত্রপন্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয় এবং এতে দুইজন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। বিক্ষোভকারীরা সরকারি ভবন ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে, যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে।

রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও ক্ষমতার লড়াই

নেপালের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও অভ্যন্তরীণ কলহ দীর্ঘদিন ধরে চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতাসীন জোটের ভাঙন এবং নতুন জোট গঠনের প্রচেষ্টা রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়িয়েছে। দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার অভাব এবং ক্ষমতার লড়াই দেশের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

KP Sharma and Puspa Komol
  • কমিউনিস্ট পার্টির বিভক্তি: ২০১৮ সালে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (এনসিপি) গঠিত হলেও কে পি শর্মা ওলি এবং পুষ্প কমল দাহাল “প্রচণ্ড”-এর মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব তীব্র হয়। ওলি ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানালে দলটি ভেঙে যায়, এবং সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়।
  • জোটের অস্থিরতা: ২০২২ সালের নির্বাচনের পর মাওবাদী দল ও নেপালি কংগ্রেসের জোট সরকার গঠন করলেও সিপিএন-ইউএমএল দলটি সমর্থন প্রত্যাহার করে নতুন জোট গঠন করে। এই ঘন ঘন জোট পরিবর্তন সরকারের পতন ডেকে আনে।
  • সংসদ ভেঙে দেওয়ার প্রক্রিয়া: ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী ওলি সংসদ ভেঙে দেন, যা সংবিধানবিরোধী বলে বিবেচিত হয়। সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করা হলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পায়।

চীন-ভারতের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব

Shi Zeen Ping and KP Sharma
  • চীনের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ: নেপালের কমিউনিস্ট দলগুলোর মধ্যে ঐক্য বজায় রাখতে চীনা কর্মকর্তারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। চীনা রাষ্ট্রদূত হোউ ইয়ানকি নেপালের নেতাদের সাথে বৈঠক করে বিভক্তি মোকাবিলার চেষ্টা করেন।
  • ভারতের প্রভাব: কালাপানি-লিপুলেখ সীমান্ত বিরোধে ওলির সিদ্ধান্তে ভারত ক্ষুব্ধ হয়। নেপালি কংগ্রেসের সমর্থনে ভারতের ভূমিকা সরকার পরিবর্তনের পেছনে কাজ করে।
  • আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা: শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের মতো নেপালেও চীন-ভারতের প্রভাব বলয়ের প্রতিযোগিতা চলছে। চীনের অর্থায়নে নির্মিত অবকাঠামো প্রকল্পগুলি ভারতের উদ্বেগ বাড়িয়েছে।

সাংবিধানিক সংকট ও আদালতের ভূমিকা

Parliament Building – Nepal
  • সংসদ ভেঙে দেওয়ার বৈধতা: সংবিধান অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভাঙতে পারেন না যদি বিকল্প সরকার গঠনের সম্ভাবনা থাকে। ওলির সিদ্ধান্ত আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
  • নতুন সরকার গঠনের জটিলতা: সংসদ ভেঙে গেলে ৩০ দিনের মধ্যে নতুন সরকার গঠনের নিয়ম আছে, কিন্তু দলগুলোর মধ্যে আস্থার অভাব এ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে।

অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও বেকারত্ব

রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি নেপালের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও নাজুক। বেকারত্বের উচ্চ হার, মুদ্রাস্ফীতি এবং বিদেশি বিনিয়োগের অভাব দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলেছে। অনেক তরুণ কর্মসংস্থানের অভাবে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন, যা দেশের মানবসম্পদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

যুবসমাজের দেশত্যাগ: বছরে ১০ লাখের বেশি তরুণ কর্মসংস্থানের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে দুর্বল করছে।

  • মুদ্রাস্ফীতি বেকারত্ব: ৮.১৯% মুদ্রাস্ফীতি এবং ব্যাংকিং খাতের সংকট জনজীবনকে বিপর্যস্ত করেছে।
  • ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন: গত এক দশকে ১১ বার প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন হয়েছে, যা জনগণের মধ্যে ক্লান্তি সৃষ্টি করেছে।
Public Demonstration – Nepal

জনগণের অসন্তোষ ও ভবিষ্যৎ

দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে নেপালের জনগণের মধ্যে অসন্তোষ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকে বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আস্থা হারিয়ে রাজতন্ত্রের দিকে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছেন – যার ফলশ্রুতিতেই ২৮ তারিখের অস্থিরতা বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এটি নেপালের ভবিষ্যতের জন্য কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, তা সময়ই বলে দেবে।

উপসংহার

নেপালের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা বহুমাত্রিক এবং এর পেছনে রয়েছে বিভিন্ন কারণ। রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং জনগণের অসন্তোষ মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। এই সংকট মোকাবিলায় সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও স্থিতিশীল নেতৃত্ব প্রয়োজন, যা নেপালকে একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি দমন, এবং বৈদেশিক হস্তক্ষেপ কমিয়ে আনা ছাড়া এই সংকটের স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। ২০২৫ সালের নির্বাচনকে ঘিরে নতুন আশার আলো দেখা গেলেও, তা বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

Share.
Leave A Reply

error: Content is protected !!
Exit mobile version