মুখবন্ধ: ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এর শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত Zelenskyy-Trump বৈঠক ঘিরে তীব্র নাটকীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি (Zelenskyy) মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাৎ করতে ওয়াশিংটনে আসেন মূলত খনিজ সম্পদ চুক্তি চূড়ান্ত করতে এবং চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত নিরাপত্তা নিশ্চয়তা নিয়ে আলোচনা করতে। কিন্তু Oval Office-এ কথোপকথন দ্রুতই উত্তেজনাপূর্ণ মোড় নেয়। পরিণতিতে নির্ধারিত চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি এবং এই হোয়াইট হাউস বিতর্ক পশ্চিমা জোটের সম্পর্কে ভাঙন ধরার আশঙ্কা তৈরি করে। নিচের অংশগুলোতে বৈঠকের উদ্দেশ্য, Oval Office-এ বিতর্কের বিস্তার, কেন খনিজ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি, বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর জেলেনস্কির প্রতিক্রিয়া, ইউরোপীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ও আলোচনার বিষয়বস্তু

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত এই উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ চুক্তি চূড়ান্ত করা। এই প্রস্তাবিত চুক্তির আওতায় ইউক্রেনের মূল্যবান ভূ-খনিজ (বিশেষ করে rare earth minerals সহ লিথিয়াম, গ্রাফাইট, ইউরেনিয়াম ইত্যাদি) আহরণ ও বিনিয়োগে পারস্পরিক সহযোগিতার কথা ছিল। যুক্তরাষ্ট্র এর মাধ্যমে কিয়েভের অপরিসীম প্রাকৃতিক সম্পদে প্রবেশাধিকার পেতে চেয়েছিল এবং বিনিময়ে ইউক্রেনকে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও সহায়তা প্রদানের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। জেলেনস্কি এই উদ্যোগকে সম্ভাব্য “বড় সাফল্য” হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন, তবে তিনি সতর্কভাবে জানিয়েছিলেন যে এটি সম্পূর্ণভাবে ট্রাম্প প্রশাসনের আচরণের ওপর নির্ভর করবে।

তবে আলোচনা কেবল খনিজ সম্পদ নিয়েই সীমাবদ্ধ ছিল না। বৈঠকের এজেন্ডায় ছিল নিরাপত্তা নিশ্চয়তা ও মার্কিন সামরিক সহায়তার ধারাবাহিকতা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ আলাপ। জেলেনস্কি স্পষ্ট করতে চেয়েছিলেন যে ইউক্রেন রাশিয়ার আগ্রাসনের মুখে টিকে থাকতে মার্কিন সহায়তার উপর নির্ভরশীল, তাই তিনি জানতে চান যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘমেয়াদে সমর্থন জারি রাখবে কিনা। বিশেষ করে, ইউক্রেন নাটো জোটে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে কি না, অতিরিক্ত অস্ত্র পেতে পারবে কিনা এবং রাশিয়ার জব্দকৃত সম্পদ ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ও পুনর্গঠনে ব্যবহার করা যাবে কিনা – এসব প্রসঙ্গ আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। জেলেনস্কি আশা করেছিলেন যে খনিজ সম্পদ চুক্তি নিরাপত্তা নিশ্চয়তা পাওয়ার পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করবে। সংক্ষেপে, Zelenskyy-Trump বৈঠক ছিল একটি অর্থনৈতিক চুক্তির পাশাপাশি ইউক্রেনের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ সমর্থন নিয়ে দুই নেতার মধ্যে বিশ্বাস ও নীতি যাচাইয়ের উপলক্ষ্য।

Oval Office-এ বিতর্কের সূচনা ও উত্তপ্ত পরিস্থিতি

আলোচনা শুরুর পরপরই হোয়াইট হাউসের Oval Office-এ পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যায় এবং একটি হোয়াইট হাউস বিতর্ক মাথাচাড়া দেয়। শুরুতে সৌজন্যমূলক কথাবার্তা হলেও, খুব তাড়াতাড়ি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স (J.D. Vance) প্রকাশ্যে জেলেনস্কিকে চাপে ফেলতে শুরু করেন। সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে ট্রাম্পের মেজাজ বিগড়ে যায় এবং তিনি ক্রমেই তিক্ত ভাষায় ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ্য করে কথা বলতে থাকেন। ট্রাম্প অভিযোগ তোলেন যে যুক্তরাষ্ট্র বিপুল সহায়তা প্রদান করা সত্ত্বেও জেলেনস্কি যথেষ্ট “কৃতজ্ঞতা” প্রকাশ করছেন না। এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উত্তেজিত স্বরে জেলেনস্কিকে সরাসরি সতর্ক করেন যে, তিনি যেন যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত মেনে শান্তিচুক্তির দিকে এগিয়ে যান, নতুবা যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন সংকট সমাধানের প্রচেষ্টায় নিজেদের গুটিয়ে নেবে। ট্রাম্পের কড়া আলটিমেটাম ছিল, “চুক্তি করুন, না হলে আমরা সরে যাব”, যা কার্যত ইউক্রেনকে রাশিয়ার সাথে শান্তির নামে আপস করতে চাপ দেয়।

এই উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডায় ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্সও সুর চড়ান। তিনি জেলেনস্কিকে তিরস্কারের সুরে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনি কি আমাদেরকে একবারও ধন্যবাদ দিয়েছেন?” – যা আসলে জেলেনস্কির দেশকে “অনুকম্পাশ্রিত” হিসেবে উপস্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্রের দয়া প্রার্থনা করছে এমন ইঙ্গিত বহন করে। Oval Office-এর পরিবেশ এতটাই গরম হয়ে উঠে যে দুই নেতা প্রায় পরস্পরের কথা কাটাকাটি অবস্থায় পৌঁছে যান এবং তাদের কণ্ঠস্বর উচ্চ হয়ে যায়। সাক্ষাৎকারের সময় উপস্থিত সবাই বিষম পরিস্থিতির আঁচ পান এবং আলোচনা ক্রমে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি পুনরায় নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করলে ট্রাম্প তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যেই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশের স্থান দখল করে নেয় সংঘাতময় বাকযুদ্ধ, যা শেষ পর্যন্ত বৈঠকের গতি সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দেয়।

কেন ‘খনিজ সম্পদ চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়নি

Oval Office-এ বিতর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে পূর্বনির্ধারিত খনিজ সম্পদ চুক্তি আর স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়নি। একপর্যায়ে তীব্র বাক-বিতণ্ডা ও ট্রাম্পের আলটিমেটামের মুখে ক্ষুব্ধ জেলেনস্কি নির্ধারিত সময়ের আগেই বৈঠক ত্যাগ করেন। ফলস্বরূপ, বহু আগেই প্রস্তুত করে রাখা চুক্তি স্বাক্ষরের আনুষ্ঠানিকতা বাতিল হয়ে যায়। উল্লেখ্য, এই চুক্তির খসড়া নিয়ে আগেই দুই দেশের মধ্যে মতবিরোধ ছিল – বিশেষ করে এতে ইউক্রেনের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা সংক্রান্ত ধারা অনুপস্থিত থাকায় কিয়েভ আপত্তি জানিয়েছিল। জেলেনস্কি জোর দিয়ে আসছিলেন যে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা এই অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে হবে, অন্যথায় শুধু খনিজ আহরণের বিনিয়োগ ইউক্রেনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে।

প্রাথমিকভাবে চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করতেও দেরি হচ্ছিল এই কারণেই যে, ট্রাম্প প্রশাসন নিরাপত্তার বিষয়টি সরাসরি অন্তর্ভুক্ত করতে অনাগ্রহ দেখায় এবং কিয়েভের কাছে কিছু “অপ্রত্যাশিত শর্ত” রাখছিল। শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সরকার নিজস্ব স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে ২৭ ফেব্রুয়ারি চুক্তির শর্ত পুনর্বিবেচনা করে অনুমোদন দেয়, যাতে দেশের জন্য বিরূপ কোনো শর্ত না থাকে বলে প্রধানমন্ত্রী ডেনিস শ্মিহাল জানান। মনে করা হচ্ছিল যে এই সমঝোতার পর ২৮ তারিখে ওয়াশিংটনে চুক্তি সই হবে এবং এটি উভয় দেশের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে। কিন্তু Oval Office-এর অপ্রত্যাশিত সংঘর্ষপূর্ণ পরিবেশ সব পরিকল্পনা ভেস্তে দেয়। ট্রাম্পের প্রকাশ্য চাপ ও অসম্মানজনক আচরণে ক্ষুব্ধ জেলেনস্কি চুক্তি স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানিকতা শুরুর আগেই সরে যান, ফলে চুক্তিটি আর আলোর মুখ দেখেনি। সহজভাবে বললে, খনিজ সম্পদ চুক্তি স্বাক্ষরিত না হওয়ার কারণ ছিল রাজনৈতিক সৌজন্যের পতন এবং বিশ্বাসের ফাটল – যা ওই নাটকীয় বৈঠকের পরিণামে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর Zelenskyy-এর প্রতিক্রিয়া

বৈঠক অস্বাভাবিক ভাবে ভন্ডূল হওয়ার পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বিচলিত হলেও কৌশলী প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করেন। হোয়াইট হাউস ত্যাগ করার পর জেলেনস্কি মিডিয়ার কাছে এবং সামাজিক মাধ্যমে অত্যন্ত বিচক্ষণ বক্তব্য দেন। তিনি মার্কিন জনগণ, কংগ্রেস এবং প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “ইউক্রেন ন্যায্য এবং স্থায়ী শান্তি চায়, আর আমরা ঠিক সেই লক্ষ্যেই কাজ করছি”। অর্থাৎ, প্রকাশ্যে তিনি কূটনৈতিক ভদ্রতার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অবদানকে স্বীকার করে নিলেও এর মধ্য দিয়ে সুক্ষ্মভাবে ইঙ্গিত দেন যে শান্তির মূল চাবিকাঠি ন্যায়সংগত অবস্থানেই নিহিত থাকা উচিত।

একটি সাক্ষাৎকারে (Fox News-এ) জেলেনস্কি জোর দিয়ে বলেন যে ইউক্রেন সেই বহু প্রতীক্ষিত খনিজ সম্পদ চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত ছিল এবং “আমরা এর জন্য প্রস্তুত” বলে নিশ্চিত করেন। তবে একই সাথে তিনি স্পষ্ট উচ্চারণে জানান যে এই অর্থনৈতিক অংশীদার্যকে ইউক্রেন একটি বৃহত্তর নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রথম ধাপ হিসেবে দেখে, যা দেশটির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অত্যন্ত জরুরি। ট্রাম্পের আলটিমেটামের পরও জেলেনস্কি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া ইউক্রেনের লড়াই চালিয়ে যাওয়া “কঠিন হবে, কিন্তু আমরা আমাদের মূল্যবোধ ত্যাগ করতে পারি না”। তার এই মন্তব্য প্রমাণ করে যে, পশ্চিমা সমর্থন সংকুচিত হলেও ইউক্রেন স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের লড়াইয়ে অটল থাকবে।

ব্যক্তিগতভাবে অপমানিত হওয়ার অনুভূতি থাকলেও জেলেনস্কি কৌশলে তার প্রতিক্রিয়াগুলোকে ইতিবাচক রাখেন, যাতে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি ইউক্রেনের পক্ষেই থাকে। এক্ষেত্রে তার কূটনৈতিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং শান্তির প্রয়োজনে ন্যায়বোধের কথা উল্লেখ করা একটি বিচক্ষণ পদক্ষেপ ছিল, যা বিপরীতে ট্রাম্পের আচরণের সঙ্গে তীব্র বৈসাদৃশ্য তৈরি করেছে। ফলস্বরূপ, বৈঠকের নাটকীয় ব্যর্থতার পর বিশ্বজনমত অনেকটাই জেলেনস্কির পক্ষে ঝুঁকে পড়ে এবং ট্রাম্পের সমালোচনা তীব্রতর হয়।

ইউরোপীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়া

হোয়াইট হাউসের এই ঘটনার পর ইউরোপীয় নেতারা প্রকাশ্যে জেলেনস্কির প্রতি সমর্থন ও ট্রাম্পের আচরণের প্রতি নৈরাশ্য ব্যক্ত করেন, যার ফলে ইউরোপীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়া শিরোনামে বেশ আলোচিত হয়। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস সরাসরি বলেন, “ইউক্রেনের নাগরিকদের চেয়ে শান্তি আর কেউ বেশি চায় না! তাই আমরা একসাথে একটি স্থায়ী ও ন্যায্য শান্তির পথ খুঁজছি। ইউক্রেন জার্মানি এবং ইউরোপের উপর নির্ভর করতে পারে”। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এম্যানুয়েল মাক্রোঁও জোর দিয়ে জানান যে রাশিয়া স্পষ্টতই আগ্রাসনকারী এবং ইউক্রেন তার শিকার; পশ্চিমাদের রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তা করা এবং রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া একদম সঠিক পদক্ষেপ ছিল এবং এই পদক্ষেপ অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। এসব মন্তব্যে ইউরোপীয় নেতারা ইঙ্গিত দেন যে, ইউক্রেনের পিঠ ঠেকে যাওয়ার সময় তাদের একজোট থাকা আবশ্যক এবং মার্কিন নেতৃত্বের বিরূপ মনোভাবের পরও ইউক্রেন একা পড়ে যাবে না।

ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি হোয়াইট হাউসের ঘটনার পর পশ্চিমা ঐক্যের বিষয়টি বিশেষভাবে তুলে ধরেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, “পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিটি বিভাজন আমাদের সবাইকে দুর্বল করে এবং যারা আমাদের সভ্যতার পতন দেখতে চায় তাদেরকেই সুবিধা দেয়… কারও জন্যই বিভাজন মঙ্গলজনক নয়”। মেলোনি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং মিত্রশক্তিগুলোর মধ্যে অবিলম্বে একটি শীর্ষ সম্মেলনের আহ্বান জানান, যেখানে ইউক্রেন সংকটসহ সমসাময়িক বড় চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় খোলামেলা আলোচনা হবে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার-এর মুখপাত্র নিশ্চিত করেন যে যুক্তরাজ্য জেলেনস্কির জন্য “অবিচল সমর্থন” বজায় রেখেছে এবং সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার ভিত্তিতে একটি স্থায়ী শান্তির পথ খুঁজতে ব্রিটেন যথাসাধ্য ভূমিকা রাখবে। এমনকি বৈঠকের আগে স্টারমার ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে ট্রাম্পকে বলেছেন যে ভবিষ্যৎ কোন শান্তিচুক্তি ইউক্রেন এবং বিশ্ব যেন গ্রহণযোগ্য হয় তা নিশ্চিত করতে হবে এবং যুক্তরাজ্য সেই লক্ষ্যে ময়দানে নামতেও প্রস্তুত।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ নেতৃত্বও জেলেনস্কিকে সমর্থন জানায়। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেয়েন সোশ্যাল মিডিয়ায় জেলেনস্কিকে উদ্দেশ করে বলেন, “আপনার মর্যাদা ইউক্রেনীয় জনগণের বীরত্বকে সম্মানিত করে। সাহস রাখুন… প্রিয় প্রেসিডেন্ট, আপনি কখনো একা নন”। ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লার্স লোক্কে রাসমুসেন ঘটনাটিকে “ইউক্রেনের জন্য পেটে ঘুষির মতো” বলে বর্ণনা করেন এবং মন্তব্য করেন যে বন্ধু দেশগুলোর মধ্যে খোলামেলা কথা হওয়ার জায়গা থাকলেও এই ভাবে ক্যামেরার সামনে প্রকাশ্যে অপমানজনক পরিস্থিতি তৈরি হওয়া একমাত্র মস্কোকেই খুশি করবে: “এতে একটাই বিজয়ী আছে, আর সে ক্রেমলিনে বসে”। এই প্রতিক্রিয়া থেকে স্পষ্ট, ইউরোপীয় রাজনীতিকরা মনে করছেন Oval Office-এর এই অপ্রত্যাশিত বিতর্ক আসলে রাশিয়ার President Putin-কে উৎসাহিত করতে পারে এবং পশ্চিমাদের ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারে।

তবে সমস্ত ইউরোপীয় নেতার অবস্থান একরকম ছিল না। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান বরাবরের মতই ভিন্ন সুরে ট্রাম্পের প্রশংসা করে বলেন, “শক্তিশালী নেতারাই শান্তি আনতে পারে, দুর্বলরা যুদ্ধ ডেকে আনে। আজ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শান্তির জন্য সাহসিকতা দেখিয়েছেন”। এটি ইউরোপের ভেতরকার একটি ক্ষুদ্র অংশের ভিন্নমতকে প্রতিনিধিত্ব করে, যারা ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সহানুভূতিশীল। তবে মূলধারার অধিকাংশ ইউরোপীয় নেতা জেলেনস্কির পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং ট্রাম্পের আচরণকে নিন্দা বা অন্তত সংশয়ে দেখেছেন। সামগ্রীকভাবে, ইউরোপীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়া ছিল জেলেনস্কির প্রতি দৃঢ় সমর্থনের বার্তা এবং পশ্চিমা ঐক্য টিকিয়ে রাখার আহ্বান, যাতে রাশিয়া এই ফাঁটলকে সুযোগ হিসেবে নিতে না পারে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব

হোয়াইট হাউসের এই নাটকীয় বিতণ্ডা শুধু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও নানা রকম প্রভাব ফেলতে পারে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মিত্রতার মাঝে প্রকাশ্য বিরোধের ছবি রাশিয়ার জন্য প্রোপাগান্ডার জ্বালানি জোগায়। ক্রেমলিন ইতোমধ্যে Oval Office-এর ঘটনাকে “বর্বর শাসানি” হিসেবে চিত্রিত করে উল্লাস প্রকাশ করেছে, যা স্পষ্ট করে যে পুতিন এই বিভাজনকে নিজের কৌশলগত জয়ের অংশ হিসেবে দেখছেন। বিশ্লেষকরা উল্লেখ করছেন, ট্রাম্প ইউক্রেন ইস্যুতে ইউরোপীয় মিত্রদের পাশে না নিয়ে আলাদা পথে হাঁটার ইঙ্গিত দিয়ে পশ্চিমাদের ঐক্য দুর্বল করছেন, যার “ফলাফল পুতিনের জন্যই লাভজনক” এবং এটি যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের সার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের নীতিকেও খর্ব করছে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এই ঘটনা অনেকটা আমেরিকার পক্ষ থেকে একজন যুদ্ধকালীন মিত্রের প্রতি “বেইমানি” করার শামিল, যা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বনেতৃত্বের নৈতিক অবস্থানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

দ্বিতীয়ত, এই বিভক্তির প্রেক্ষিতে ইউরোপীয় দেশগুলো নিজেদের ভূমিকা বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। ট্রাম্পের অনীহা দেখেই ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য আগে থেকেই ৩০,০০০ সৈন্যের একটি সম্ভাব্য ইউরোপীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী ইউক্রেনে মোতায়েনের পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে, যাতে প্রয়োজনে যুদ্ধবিরতি হলে ময়দানে নেমে ইউক্রেনকে সুরক্ষা দিতে পারে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র যদি পিছু হটে, ইউরোপ যেন ন্যূনতমভাবে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে সেই প্রচেষ্টা চলছে। ইউরোপীয় নেতারা বারবার বলছেন যে ইউক্রেনের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার প্রকৃত উপায় হল তাকে ন্যাটোর ছাতার নিচে আনা এবং দৃঢ় নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেয়া। তাই, হোয়াইট হাউসের এই ঘটনার পর ইউরোপ সম্ভবত আরও জোরালোভাবে ইউক্রেনের পক্ষে কূটনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপ নেবে, যাতে আন্তঃআলায়েন্স (Alliance) ফাঁটলের প্রভাব মোকাবিলা করা যায়।

তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের প্রতি আস্থা কিছুটা ক্ষুণ্ণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে মিত্র দেশগুলো এখন ভাববে যে প্রশাসন বদলালে বা ভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব এলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি ও অবস্থান dramatic ভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। এর ফলে ভবিষ্যতে দেশগুলো বিকল্প জোট বা নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রতি জোর দিতে পারে। যেমন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো মিলে স্বাধীন নিরাপত্তা কাঠামো জোরদার করার কথা এখন আগের চেয়েও বেশি উচ্চারিত হচ্ছে।

সব মিলিয়ে, জেলেনস্কি-ট্রাম্প Oval Office বিতর্ক তাৎক্ষণিকভাবে খনিজ সম্পদ চুক্তি ভেস্তে দিলেও এর ঢেউ অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে। পশ্চিমা বিশ্বকে হয়তো নিজেদের অভ্যন্তরীণ ঐক্য আরও মজবুত করার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে এবং রাশিয়া ও তার মিত্ররা এই ফাঁক গলে যেন কূটনৈতিক সুবিধা নিতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্য ও নীতিগত অবস্থানের ধারাও এই ঘটনার পর নতুনভাবে মূল্যায়ন করা হবে – যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও বিশেষ নজরে থাকবে।

উপসংহার

Zelenskyy-Trump বৈঠক যে লক্ষ্য নিয়ে আয়োজন করা হয়েছিল, সেই লক্ষ্য পূরণ তো দূরের কথা, উল্টো ঘটনাক্রম উভয় দেশের সম্পর্কে নতুন জটিলতা সৃষ্টি করেছে। Oval Office-এর হোয়াইট হাউস বিতর্ক দেখিয়ে দিয়েছে যে ইউক্রেন-যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারিত্বে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য কতটা গভীরে। খনিজ সম্পদ চুক্তি স্বাক্ষরিত না হওয়া শুধু অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের ব্যর্থতা নয়, বরং এর সাথে জড়িত নিরাপত্তা নিশ্চয়তার প্রশ্নটিও অনিশ্চয়তায় পড়েছে। জেলেনস্কি সঙ্কটময় মুহূর্তেও ধৈর্য ও কূটনীতি দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করেছেন, আর ইউরোপীয় নেতারা দ্রুত তাকে সমর্থন জানিয়ে পশ্চিমাদের ঐক্যের বার্তা দেয়ার চেষ্টায় নেমেছেন। অন্যদিকে, এই প্রকাশ্য বিরোধ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে – মিত্রদের মধ্যে উদ্বেগ এবং প্রতিপক্ষদের মধ্যে উৎসাহ দুই-ই স্পষ্ট।

এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণে দেখা যায়, একটি মাত্র বিতর্কিত বৈঠক কতটা ব্যাপক প্রভাব ছড়াতে পারে। ইউক্রেন সংকটে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা এখন নতুন মোড় নিয়েছে; ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অবস্থান পশ্চিমা ঐক্যের পরীক্ষা নিচ্ছে এবং ইউক্রেনকে সমর্থন অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি নবায়নের জন্য মিত্রদেরকে সমন্নিত ভাবে উদ্যোগী হতে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত, এই ঘটনা থেকে শিক্ষা হল যে পারস্পরিক সম্মান, কূটনৈতিক সংযম এবং যৌথ কৌশলই কাক্ষিত লক্ষ্য – ন্যায়সঙ্গত শান্তি ও স্থিতিশীলতা – অর্জনের পথকে সুগম করতে পারে, তা সে খনিজ সম্পদ চুক্তি হোক বা বৃহত্তর নিরাপত্তা জোটের প্রতিশ্রুতি। পশ্চিমা বিশ্ব যদি এধরনের বিভক্তি কাটিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে পারে, তবে রাশিয়ার মতো আগ্রাসী শক্তিকে প্রতিহত করে ইউক্রেনে ন্যায়সংগত ও টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠা করা এখনও সম্ভব। সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই বিতর্কিত বৈঠক পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যে যে আলোড়ন তুলেছে, তা ভবিষ্যতে তাদের নীতিমালা ও সহযোগিতার রূপরেখা পুনর্বিবেচনা করতে উৎসাহিত করবে – যাতে আর কোন ভুল বোঝাবুঝি বা অবিশ্বাসের সুযোগ না থাকে এবং ইউক্রেন যেন নির্ভয়ে নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও পুনর্গঠনের পথে এগোতে পারে।

Share.
Leave A Reply

error: Content is protected !!
Exit mobile version