বাংলাদেশের বায়ুদূষণের বর্তমান চিত্র:
বাংলাদেশ আজ শিল্পায়ন, নগরায়ন আর উন্নয়নের এক অভিযাত্রায় এগিয়ে চলেছে। কিন্তু এই অগ্রগতির ছায়ায় লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ বিপদ—বায়ুদূষণ।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক বায়ু মান প্রতিবেদন ২০২৪’ অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০২৪ সালে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বায়ুদূষণের দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে পিএম ২.৫-এর গড় উপস্থিতি ছিল ৭৮ মাইক্রোগ্রাম, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ডের চেয়ে অন্তত ১৫ গুণ বেশি।
ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ:
নগর পর্যায়ে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ বায়ুদূষিত শহর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ঢাকার বাতাসে পিএম ২.৫-এর গড় উপস্থিতি ছিল ৭৮ মাইক্রোগ্রাম, যা আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কম হলেও এখনও শীর্ষ দূষিত নগরগুলোর মধ্যে রয়েছে।
কেন এত দূষণ?
(ছবি: ঢাকার যানবাহনের ধোঁয়া, ইটভাটার কালো ধোঁয়া, এবং নির্মাণাধীন স্থাপনার ধুলো)
বাংলাদেশের বায়ুদূষণ একটি গুরুতর সমস্যা, যা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মানদণ্ড অনুযায়ী, ২০২৪ সালে মাত্র সাতটি দেশ বায়ুর গুণমানের মান পূরণ করতে পেরেছে, যেখানে বাংলাদেশ সবচেয়ে দূষিত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল।
বায়ুদূষণের প্রধান কারণসমূহ:
- ইটভাটা: বাংলাদেশে প্রচুর সংখ্যক ইটভাটা রয়েছে, যা বায়ুদূষণের একটি প্রধান উৎস। অনেক ইটভাটা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার না করে, যা বায়ুতে ক্ষতিকর পদার্থের মাত্রা
- যানবাহনের ধোঁয়া: পুরনো ও অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণযুক্ত যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া বায়ুদূষণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে, যানজটপূর্ণ এলাকায় এই সমস্যা আরও প্রকট।
- শিল্পকারখানা: অনিয়ন্ত্রিত শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য ও ধোঁয়া পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে, টেক্সটাইল ও সিমেন্ট শিল্প থেকে নির্গত সালফার ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য দূষক পদার্থ বায়ুদূষণ বাড়ায়।
- নগরায়ণ ও নির্মাণকাজ: নগরায়ণ ও নির্মাণকাজের সময় সৃষ্ট ধুলা ও বর্জ্য বায়ুদূষণ বাড়ায়। নিয়মিত পানি ছিটানোর মতো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় এই ধুলা বাতাসে মিশে যায়।
স্বাস্থ্যঝুঁকি: অদৃশ্য ঘাতক
বায়ুদূষণের ফলে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ফুসফুসের রোগ, হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের মতো গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ এবং দুর্বল স্বাস্থ্যের ব্যক্তিদের জন্য এটি অত্যন্ত ক্ষতিকর। একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বায়ুদূষণ উচ্চ রক্তচাপের পরেই মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম ঝুঁকিপূর্ণ কারণ।
বায়ুদূষণের বিষক্রিয়া এখন প্রতিটি বাড়িতে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১.২ লাখ মানুষ বায়ুদূষণজনিত রোগে মারা যান। এর মধ্যে শীর্ষে আছে ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, এবং শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ। শিশু ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। ঢাকার একটি ক্লিনিকের ডাক্তার ডা. তাসনিম হাসান বলেন, “গত পাঁচ বছরে শ্বাসকষ্টের রোগীর সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে। নতুন করে অ্যালার্জিজনিত অ্যাজমা বাড়ছে শিশুদের মধ্যে।”
কী করতে পারি আমরা?
বায়ুদূষণ রোধে শুধু সরকারি পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়, চাই জনসচেতনতা ও সম্মিলিত উদ্যোগ:
- পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার: ইটভাটা ও শিল্পকারখানায় পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি প্রয়োগ করা। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বায়ুদূষণ কমাতে সহায়তা করবে।
- যানবাহনের মানোন্নয়ন: পুরনো যানবাহন প্রতিস্থাপন ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা। সিএনজি বা বৈদ্যুতিক যানবাহনের ব্যবহার বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
- সবুজায়ন: নগর ও গ্রামাঞ্চলে বৃক্ষরোপণ বৃদ্ধি করা। গাছপালা বায়ু থেকে দূষক পদার্থ শোষণ করে পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখতে সহায়তা করে।
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি: বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা। স্কুল, কলেজ এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো যেতে পারে।
- কঠোর আইন প্রয়োগ: পরিবেশ সংক্রান্ত আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা। দূষণকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
আশার কথা
বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০২৩ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর ৫০টির বেশি অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করেছে। ঢাকায় মেট্রোরেল ও বাস র্যাপিড ট্রান্সপোর্ট (বিআরটি) চালু হওয়ায় যানবাহনের চাপ কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবুও, এই সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন সকল স্তরের সমন্বয়।
উপসংহার:
বাংলাদেশের বায়ুদূষণ একটি গুরুতর সমস্যা, যা সমাধানে সরকার, শিল্পমালিক, পরিবেশবিদ এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। পরিবেশ রক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে আমাদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
বায়ুদূষণ কোনো “আবহাওয়ার সমস্যা” নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের সংকট। আজ যদি আমরা সচেতন না হই, আগামী প্রজন্ম একটি বিষাক্ত পৃথিবী পাবে। আসুন, যার যার নিজের অবস্থান থেকে ছোট ছোট উদ্যোগ নেই। একটি গাছ লাগাই, গাড়ি কম চালাই, পরিবেশবান্ধব অভ্যাস গড়ে তুলি। মনে রাখবেন, নির্মল বাতাস সকলের মৌলিক মানবাধিকার—এ অধিকার রক্ষার দায়িত্ব সবার।