বাংলাদেশের তরুণ ছাত্র-জনতা এখন এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে প্রকৃত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে, গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত হবে, এবং সামাজিক ন্যায্যতা বজায় থাকবে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে তরুণ সমাজ পরিবর্তনের আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এসেছে। এই ব্লগ পোস্টে আমরা রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে আলোচনা করবো কীভাবে তারা এই পরিবর্তন আনতে চায়, কী ধরনের বাংলাদেশ তারা দেখতে চায়, এবং এই রূপান্তরের পথে কী কী বাধা রয়েছে।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সামাজিক প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট তরুণদের প্রত্যাশা অনুযায়ী নয়। গণতান্ত্রিক মানদণ্ড ও আইনের শাসনের সূচকে দেশের অবস্থান উদ্বেগজনক। আন্তর্জাতিক মূল্যায়নে বাংলাদেশ প্রতিনিধিত্ব, নাগরিক অধিকার ও আইনের শাসনের ক্ষেত্রে নিম্ন পর্যায়ে অবস্থান করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা কমে যাওয়া, সহিংসতা ও কারচুপির অভিযোগ উঠেছে, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করছে। একই সঙ্গে দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০২২ সালের দুর্নীতির ধারণাসূচকে ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৭তম, যা প্রমাণ করে শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহির ঘাটতি রয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মূল্যায়নেও দেশের স্বাধীনতা সীমিত; উদাহরণস্বরূপ ফ্রিডম হাউজের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে “আংশিক মুক্ত” বলে অভিহিত করা হয়েছে এবং স্কোর ছিল ১০০ এর মধ্যে মাত্র ৪০।

এই প্রেক্ষাপটে তরুণ প্রজন্মের হতাশা বেড়েছে। সামাজিকভাবে, শিক্ষিত যুবকদের একাংশ বেকারত্ব ও অসম সুযোগের মুখোমুখি হচ্ছে। অনেকেই মনে করে রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতির কারণে মেধা ও পরিশ্রম অনুযায়ী ফল পাওয়া কঠিন। বিচারহীনতা ও ক্ষমতাসীনদের প্রভাবমুক্ত ন্যায়বিচারের অভাব তরুণদের মধ্যে পরিবর্তনের তাগিদ সৃষ্টি করেছে। ফলে তারা বর্তমান বাস্তবতায় সংস্কার চায় এবং একটি সুষ্ঠু, ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্নে অনুপ্রাণিত হচ্ছে।

ছাত্র-জনতার চলমান আন্দোলনের কারণ প্রভাব

২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন সারা দেশের মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ঢাকায় দুই শিক্ষার্থী বেপরোয়া বাসচালকের চাপায় নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে এবং ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে সরকারের কাছে কার্যকর পদক্ষেপের দাবি জানায়। এই আন্দোলন দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমদিকে শান্তিপূর্ণ হলেও, পরে পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে এবং সরকার-সমর্থিত ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। এই সহিংস দমন-পীড়নের ঘটনায় দেশ-বিদেশে তীব্র সমালোচনা হয়। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে সরকার দ্রুত নতুন সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় কিছু পরিবর্তন আনে। তবে অনেকের মতে আইনে শাস্তির মাত্রা পর্যাপ্ত ছিল না এবং দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবহন খাতে আরও ভিত্তিমূলক সংস্কার প্রয়োজন ছিল।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন

একই বছরে চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আরেকটি ছাত্র আন্দোলন দানা বাঁধে। সরকারি চাকরিতে ৫৬% পদ বিভিন্ন কোটা হিসেবে সংরক্ষিত থাকায় সাধারণ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের সুযোগ সীমিত হচ্ছিল। এ অবস্থায় মেধাভিত্তিক নিয়োগ ও সমতার দাবিতে দেশব্যাপী শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ শুরু করে। টানা বিক্ষোভ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মুখে সরকার কোটা পদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়। হাজারো শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে মহাসড়ক অবরোধ করে যে চাপ সৃষ্টি করেছিল, তার ফলस्वরূপ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কোটা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত নেন। এই সফলতা তরুণদেরকে দেখিয়েছে যে সংঘবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পরিবর্তন আনা সম্ভব।

উল্লেখযোগ্যভাবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তরুণরা বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছে। ২০২০ সালে ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংস ঘটনার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ মিছিল ও মানববন্ধন করেছে। এর ফলে সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। এছাড়া পরিবেশ রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা, পাহাড়ে ভূমি দখল বন্ধ, এবং আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার মতো বিষয়েও ছাত্র ও যুবসমাজের সচেতন অংশটি আওয়াজ তুলছে। প্রতিটি আন্দোলন কিছু না কিছু পরিবর্তন বা সচেতনতা নিয়ে আসে – নিরাপদ সড়ক আইন প্রণয়ন, কোটা বাতিল, নারী নির্যাতনবিরোধী কঠোর আইন ইত্যাদি তার উদাহরণ। একই সঙ্গে এসব ঘটনা তরুণ প্রজন্মের মনে আত্মবিশ্বাস জাগিয়েছে যে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে পরিবর্তন সম্ভব।

তবে, এসব আন্দোলন দমাতে প্রায়ই ক্ষমতাসীনদের কঠোর হস্তক্ষেপ নজরে আসে। শান্তিপূর্ণ ছাত্রপ্রতিবাদেও পুলিশি অ্যাকশন, গ্রেফতার এবং সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনের হামলার অভিযোগ উঠেছে। তা সত্ত্বেও তরুণরা বিভিন্ন কৌশলে প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছে এবং সাধারণ জনগণের সমর্থনও পাচ্ছে। চলমান এই ছাত্র-জনতার জাগরণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে, যা ভবিষ্যতের পরিবর্তনের জন্য ভিত্তি রচনা করছে।

তারা কী ধরনের সামাজিক রাজনৈতিক পরিবর্তন চায়

তরুণ ছাত্র-জনতা যে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছে, তার মূলেও আছে একটি ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক ও সমতাপূর্ণ বাংলাদেশ গড়া। যেকোনো ভাবে মনে প্রাণে তারা যে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো চায় সেগুলো হলো:

  • সঠিক ন্যায়বিচার আইনের শাসন: বিচার বিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করবে, যাতে অপরাধী যে-ই হোক শাস্তি নিশ্চিত হয়। ক্ষমতাবানদের আইনের ঊর্ধ্বে থাকার সংস্কৃতি বন্ধ করে সবার জন্য সমান বিচার নিশ্চিত করা তরুণদের অন্যতম চাওয়া। বিচারহীনতার অবসান এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি ঘটনায় যথাযথ তদন্ত ও শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি বলে তারা মনে করে।
  • গণতান্ত্রিক অধিকার সুশাসন: তরুণ প্রজন্ম এমন বাংলাদেশ চায় যেখানে ভোটের অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পূর্ণমাত্রায় থাকবে। অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজন, শক্তিশালী সংসদ ও বিরোধীদল, এবং প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা তাঁদের লক্ষ্য। তারা চায় সরকার জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করবে, প্রভাবশালী মহলের স্বার্থরক্ষায় নয়। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বজায় রাখাও তাদের চাওয়া।
  • স্বাধীন মতপ্রকাশ সাংবাদিকতার স্বাধীনতা: তরুণরা মুক্ত চিন্তা ও বাক-স্বাধীনতার পক্ষে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ যেসব আইন মতপ্রকাশ দমাতে ব্যবহৃত হচ্ছে সেগুলো বাতিল বা সংশোধন চাইছে তারা। সমালোচনামূলক মতামত প্রকাশের কারণে যেন কারোর ওপর নির্যাতন নেমে না আসে, সেই পরিবেশ তৈরির দাবি উঠছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে দুর্নীতি ও অনিয়ম উন্মোচনের ক্ষেত্র প্রসারিত করাও এ পরিবর্তনের অংশ।
  • সামাজিক ন্যায্যতা সমতা: একটি সামাজিক ন্যায্য বাংলাদেশ গড়তে তরুণরা বৈষম্যহীন সমাজ চায়। শহর ও গ্রামের মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। ধনী-দরিদ্রের আয়বৈষম্য কমানো, নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করা এবং সব ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠীর মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই তাদের লক্ষ্য। সুবিধাবঞ্চিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলতা বাড়িয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ব্যবস্থা গড়া তরুণদের চাওয়া।
  • দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন মেধার মূল্যায়ন: তরুণ প্রজন্ম এমন বাংলাদেশ চায় যেখানে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি অনিয়ম থাকবে না। মেধা, যোগ্যতা ও পরিশ্রমের ভিত্তিতে যেন মানুষ চাকরি ও সুযোগ পায়, সেই পরিবেশ তৈরি করাই তাদের উদ্দেশ্য। সরকারি পরিষেবায় স্বচ্ছতা আনতে এবং আমলাতন্ত্রের জবাবদিহিতা বাড়াতে প্রশাসনিক সংস্কারের দাবিও তারা তুলছে। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ গড়তে চায় আজকের যুবসমাজ।

উপরের পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়িত হলে তরুণরা মনে করে দেশটিতে সামাজিক শান্তি স্থিতিশীলতা ফিরবে এবং সর্বস্তরের মানুষের জীবনে উন্নতি আসবে। আদর্শভাবে তারা একটি এমন বাংলাদেশ কল্পনা করে যেখানে সবার জন্য ন্যায়, সবার জন্য অধিকার” বাস্তবে রূপ নেয়। এই আকাঙ্ক্ষাগুলোই তাদের আন্দোলন ও প্রচেষ্টার প্রেরণা জোগাচ্ছে।

ইতিহাসের আলোকে ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকা

বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক পরিবর্তনে ছাত্র তরুণ সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অতীতের এই আন্দোলনগুলো আজকের তরুণদের অনুপ্রাণিত করছে এবং দিশা দেখাচ্ছে:

  • ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন: বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্ররাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত সমাবেশের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ গণপ্রতিবাদ সংগঠিত করেন। পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ কয়েকজন ছাত্র শহীদ হন এবং দেশব্যাপী তীব্র প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। শেষপর্যন্ত গণদাবির মুখে কেন্দ্রীয় সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়; বাংলাকে ১৯৫৬ সালে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ভাষা আন্দোলন বাঙালির জাতীয় আত্মপরিচয়ের বীজ বপন করেছিল এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতার সংগ্রামের ভিত্তি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছিল।
  • ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান: পাকিস্তানি শাসক আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের অসন্তোষ থেকে শুরু হয়ে ক্রমে একটি গণ-বিপ্লবে রূপ নেয়। ১৯৬৮ সালের শেষদিকে ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত হলে তা দ্রুত শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রনেতারা একত্রিত হয়ে ১১ দফা দাবি ঘোষণা করেন, যেখানে স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক মুক্তির দাবিগুলোও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই ১১ দফা আন্দোলন পুরো পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে জনজাগরণ সৃষ্টি করে এবং আইয়ুব সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। অবশেষে গণআন্দোলনের চাপে আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন; বন্দী অবস্থায় থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ রাজনৈতিক নেতারা মুক্তি লাভ করেন। এই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রাক্কালে জনগণের মনে স্বাধীনতার চেতনা আরও গভীর করে এবং মুক্তিযুদ্ধের পথ প্রশস্ত করে।
  • ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন: স্বাধীনতার পরে ১৯৮০’র দশকে সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ ঘটে ১৯৯০ সালে। ছাত্র সংগঠনগুলো সব রাজনৈতিক মতভেদের ঊর্ধ্বে উঠে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তোলে। টানা অবরোধ, ধর্মঘট ও বিক্ষোভে নভেম্বরে সমগ্র দেশ অচল হয়ে পড়ে এবং সরকারের ওপর চাপ চরমে পৌঁছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে এরশাদ মার্শাল ল’ জারির চেষ্টা করেন, কিন্তু সেনাবাহিনী তাতে সমর্থন দেয়নি। সর্বশেষ ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যা দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়। এই আন্দোলনে ছাত্রসমাজের ত্যাগও চিরস্মরণীয়: নূর হোসেনের মতো সাহসী তরুণ বুকে-পিঠে “গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক” স্লোগান লিখে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ৯০-এর ছাত্র গণঅভ্যুত্থান প্রমাণ করে তরুণরাই দেশে গণতন্ত্র ফেরাতে প্রধান চালিকা শক্তি হতে পারে।
  • অন্যান্য আন্দোলন: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এ ছাড়া ১৯৮৩ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ২০০৬-০৭ সালের সংস্কারপন্থী ছাত্রআন্দোলন এবং ২০১৩ সালের শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের মতো আন্দোলনগুলোতেও ছাত্র ও যুবকদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। এসবের মাধ্যমে কোনোটা সরাসরি শাসক পরিবর্তন না করলেও সামাজিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতিতে প্রভাব রেখেছে। উদাহরণ হিসেবে, শাহবাগের যুব আন্দোলন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়িয়েছে।

ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, যখনই দেশ গভীর সংকটে পড়েছে বা বড় পরিবর্তনের দরকার হয়েছে, তরুণ সমাজ পথ দেখিয়েছে। তাদের ত্যাগ, সাহস ও নেতৃত্বে স্বাধিকার ও গণতন্ত্রের লড়াই সফল হয়েছে। এই ঐতিহ্য বর্তমান প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করছে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে তরুণরা শিক্ষা নিচ্ছে কীভাবে আন্দোলন সংগঠিত করতে হয়, কিভাবে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হয় এবং কীভাবে দাবী আদায় করতে হয়। ইতিহাসের আলোকে তারা বুঝতে পারছে যে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনা সম্ভব।

বর্তমান সময়ের প্রতিবন্ধকতা সম্ভাব্য সমাধান

বাংলাদেশের তরুণ ছাত্র-জনতা পরিবর্তনের জন্য উদ্দীপ্ত হলেও বর্তমান সময়ে তাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে নানা প্রতিবন্ধকতা। এসব বাধা অতিক্রম করে লক্ষ্য অর্জন করতে কয়েকটি কৌশল ও সমাধান নিয়ে ভাবতে হচ্ছে:

দমন-পীড়নের চেষ্টা

১. রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন আইনি বাধা: সাম্প্রতিককালে সরকার বিরোধী মত ও আন্দোলন দমনে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (DSA) প্রভৃতি আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে অনলাইনে মতপ্রকাশ করলেই গ্রেফতার ও হয়রানির শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, বাংলাদেশে ভিন্নমত দমন করার সংস্কৃতি ক্রমেই বেড়েছে এবং সমালোচকদের কণ্ঠ রোধ করতে আইনি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি ছাত্র-জনতার আন্দোলনগুলোর সময়েও প্রচণ্ড দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে — পুলিশের গুলি বলপ্রয়োগে প্রাণহানিও ঘটেছে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনও আন্দোলনকারীদের ওপর সহিংস আক্রমণে লিপ্ত হয়েছে বলে একাধিক সূত্রে অভিযোগ উঠেছে। এই পরিস্থিতি তরুণদের জন্য বড় বাধা সৃষ্টি করেছে; অনেকে ভয়ে মুখ খোলার সাহস পায় না এবং সামাজিক আন্দোলন চাঙ্গা করতেও দ্বিধাগ্রস্ত হয়।

সম্ভাব্য সমাধান: দমন-পীড়নের মুখে টিকে থাকতে তরুণদের কৌশলী শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে হবে। অতীতে যেমন গান্ধীগিরি বা অহিংস আন্দোলন বিশ্বে সফল হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও ছাত্র-জনতা সহিংসতা পরিহার করে সৃজনশীল প্রতিবাদের পথ নিতে পারে। আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং সমর্থন লাভ করাও একটি কৌশল হতে পারে — যেমন বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও গণমাধ্যমে পরিস্থিতি তুলে ধরা। বৈশ্বিক চাপ কখনও কখনও সরকারের উপর নীতি পরিবর্তনের চাপ তৈরিতে কার্যকর হতে পারে। একই সাথে, বিতর্কিত আইনগুলোর অপব্যবহার আদালতের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করা বা জনমত গঠন করে আইন বাতিলের দাবি জোরদার করাও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্বে থাকায় এসব দমনমূলক আইন পুনর্বিবেচনার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে, যার সদ্ব্যবহার করতে হবে।

২. রাজনৈতিক প্রভাব দলীয় আধিপত্য: দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে দলীয় ছাত্রসংগঠনের প্রভাব আছে, যা অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ ছাত্রদের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ ও আন্দোলন গড়ে তোলার পথে বাধা। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে আধিপত্য করেছে এবং ভিন্নমত দমনে শক্তি প্রয়োগের অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ব্যাহত হয় এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভয় ও চাপের মধ্যে থাকে। তাছাড়া জাতীয় রাজনীতিতেও দুটি প্রধান দল বহু বছর ধরে ক্ষমতার পালাবদল ঘটালেও তরুণদের জন্য তেমন জায়গা সৃষ্টি করতে পারেনি, বরং দলীয় কাঠামোতে যুবসমাজ অনেকসময় উপেক্ষিত।

সমাধান হতে পারে ঐক্যবদ্ধ মোর্চা গঠন”অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরির মাধ্যমে দলীয় প্রভাব কাটিয়ে ওঠা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে একটি অরাজনৈতিক ছাত্র ঐক্য গড়ে তুললে দলীয় শক্তির চোখরাঙানিকে পাশ কাটিয়ে যৌথ আন্দোলন চালানো সহজ হবে। ১৯৬৯ বা ১৯৯০-এর মতো সময়গুলোতে বিভিন্ন মতের ছাত্র সংগঠনও বৃহত্তর স্বার্থে একসাথে আন্দোলন করেছে; এখনও তেমন ঐক্য দরকার। এছাড়া ক্যাম্পাসে সুস্থ রাজনীতি ফেরাতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত আয়োজন এবং সকল দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করাও সমাধানের অংশ। জবাবদিহিমূলক ছাত্ররাজনীতি ফেরালে দলীয় অনিয়ন্ত্রিত আধিপত্য কমানো সম্ভব এবং প্রকৃত ছাত্রনেতৃত্ব বিকাশ পাবে।

৩. জনসাধারণের সংযোগ আন্দোলনের ধারাবাহিকতা: অনেক সময় ছাত্রদের আন্দোলনগুলি শহর-কেন্দ্রিক বা একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মাঝে সীমাবদ্ধ থেকে যায়, পুরো জনগোষ্ঠীর সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়। ফলে আন্দোলন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে সরকারের ওপর চাপ কমে যায় এবং লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে। যেমন, কোনো আন্দোলন যদি শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী শ্রেণিকে সম্পৃক্ত করতে না পারে, তাহলে তা একসময় শক্তি হারিয়ে ফেলে। এ ছাড়া নিরাপত্তাহীনতা ও দমনের শিকার হয়ে মাঝে মাঝে আন্দোলনের গতি নষ্ট হয় এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখা চ্যালেঞ্জ হয়।

এই সমস্যার সমাধানে ছাত্র-জনতাকে বৃহত্তর জনসম্পৃক্ততা তৈরি করতে হবে। নিজেদের দাবিগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে যাতে সর্বস্তরের মানুষের কাছে তা গ্রহণযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। উদাহরণস্বরূপ, কেবল ক্যাম্পাসের সমস্যা নয়, বরং জাতীয় সমস্যা (দুর্নীতি, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি) নিয়ে কথা বললে সাধারণ মানুষও তাদের আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করবে। শহর-গ্রামে সচেতনতা প্রচারণা চালানো, সামাজিক মাধ্যমে প্রচার অভিযান এবং স্থানীয় পর্যায়ে গণসংযোগের মাধ্যমে আন্দোলনের বার্তা সবার কাছে পৌঁছানো জরুরি। তাছাড়া অনড় মনোবল ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ – হঠাৎ করেই যেন আন্দোলন থেমে না যায় বা বিভ্রান্তি না ছড়ায় সেদিকে নেতৃত্বকে সতর্ক থাকতে হবে। দাবিগুলো আংশিক পূরণ হলেও পুরো লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত আন্দোলনের মোমেন্টাম বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন।

৪. নেতৃত্বের সংকট অভিজ্ঞতার অভাব: তরুণ আন্দোলনকারীদের অনেকেই রাজনীতিতে একেবারে নতুন মুখ, ফলে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত ও অভিজ্ঞ নেতৃত্বের অভাব দেখা দিতে পারে। অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের কূটকৌশল মোকাবিলা করা বা রাষ্ট্র পরিচালনার রূপরেখা দেওয়ার মতো দক্ষতা উন্নত করতে তরুণদের সময় ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। যদি আন্দোলনের পর ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে, তখন নতুন নেতৃত্ব তৈরির প্রশ্ন আসে – সেখানে অভিজ্ঞতার অভাব সমস্যার কারণ হতে পারে।

সমাধান হিসেবে, তরুণ প্রজন্মের সক্ষমতা বৃদ্ধি জ্ঞান অর্জন জরুরি। আন্দোলনের পাশাপাশি রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রশাসন বিষয়ে জ্ঞানচর্চা করা, বিশেষজ্ঞদের সাথে সংলাপ করা এবং অন্যান্য দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে শেখা উচিত। বিভিন্ন কর্মশালা, সেমিনার ও ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে তরুণ নেতাদের দক্ষতা বাড়ানো যেতে পারে যাতে তারা ভবিষ্যতে দায়িত্ব এলে সুচারুভাবে পালন করতে পারেন। সিনিয়র সিভিল সোসাইটি মেম্বার, শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণকারী প্রবীণরা তরুণদের মেন্টর হিসাবে দিকনির্দেশনা দিলে Leadership gap অনেকটাই পূরণ সম্ভব। এক কথায়, শিখতে হবে এবং নেতৃত্বে বিকশিত হতে হবে” – এই মন্ত্রে তরুণদের নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে।

৫. নৈতিক চ্যালেঞ্জ স্থিতিশীলতার প্রশ্ন: কোনো বড় পরিবর্তনের আন্দোলনে সময় লাগতে পারে এবং পথে নানা প্রলোভন কিংবা ভীতি দেখানো হতে পারে। তরুণ আন্দোলনকারীদের ভেতরে ভাঙন ধরাতে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টাও হতে পারে। অনেকে দীর্ঘ লড়াইয়ে হতাশ হয়ে হাল ছাড়ার ঝুঁকিও আছে। আবার আন্দোলনে সফল হলে পরবর্তীতে ক্ষমতায় গিয়ে আদর্শ ধরে রাখা বা সিস্টেম পরিবর্তন করা কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে।

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আদর্শের প্রতি অবিচল থাকা এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখা জরুরি। আন্দোলনের শুরুতেই অংশগ্রহণকারীদের মাঝে সুস্পষ্ট নৈতিক পথনির্দেশনা ও শৃঙ্খলা মেনে চলার চেতনা গড়ে তুলতে হবে। নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ, ঈর্ষা বা স্বার্থের সংঘাত দূর করতে পারলে আন্দোলনটিকে বিভ্রান্ত করা কঠিন হবে। যেকোনো প্রলোভন – তা পদ, অর্থ বা সুবিধা যা-ই হোক – এড়ানোর মানসিক প্রস্তুতি রাখা জরুরি, যাতে আন্দোলনকারীরা কিনে নেওয়া না যায়। তাছাড়া দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তনের রোডম্যাপ ঠিক করা উচিত – স্বল্পমেয়াদে কী চাই এবং দীর্ঘমেয়াদে কীভাবে লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে, সেই পরিকল্পনা থাকা দরকার। এতে করে আন্দোলন সফল হলে তার পরের ধাপগুলোও অগ্রসর করা সম্ভব হবে এবং আদর্শ বিচ্যুতির আশঙ্কা কমবে।

একদফার আন্দোলন শুরু

উপরের প্রতিবন্ধকতাগুলো বাস্তব, কিন্তু সঠিক কৌশল ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে এসব অতিক্রম করা অসম্ভব নয়। বাংলাদেশের তরুণেরা ইতোমধ্যে তাদের সৃজনশীলতা দৃঢ়তা দিয়ে অনেক কঠিন পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে তারা আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মেও সংহতি পাচ্ছে এবং নানা নতুন পদ্ধতিতে প্রতিবাদ সংগঠিত করছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সমর্থন জোগাড় করে এবং অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে তরুণরা এই বাধাগুলো পেরিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর।

ভবিষ্যতে ছাত্র-জনতার করণীয় সম্ভাব্য ফলাফল

বর্তমান আন্দোলন এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা যদি ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা কয়েকটি সম্ভাব্য চিত্র দেখতে পাই। তরুণ ছাত্র-জনতার সামনে করণীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক ও সম্ভাব্য ফলাফল নিচে তুলে ধরা হলো:

করণীয় ১: গণতান্ত্রিক ধারায় অবিচল থেকে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া: সাম্প্রতিক ছাত্র-গণআন্দোলনের ফলে বাংলাদেশে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সূচনা ইতোমধ্যেই হয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ঘটে এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠিত হয়। এ অন্তর্বর্তী সরকারে কয়েকজন তরুণ ছাত্রনেতাকে পরামর্শক পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে এক অভূতপূর্ব পদক্ষেপ। আগামী দিনে ছাত্র-জনতার করণীয় হবে এই অর্জনকে অর্থবহ করে তোলা – অর্থাৎ নিশ্চিত করতে হবে যে অন্তর্বর্তী পর্যায়ের পর সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠন হয়। তরুণদের এখন ভোটার হিসেবে সক্রিয় থাকা, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বজায় রাখতে পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করা এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে চাপ দেওয়া দরকার যেন তারা তরুণবান্ধব এজেন্ডা গ্রহণ করে। শুধু সরকার পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়, ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে – তাই নতুন সরকার গঠনের পরও সংবিধান ও প্রতিষ্ঠানগত সংস্কার চালিয়ে যেতে তরুণ সমাজকে সোচ্চার থাকতে হবে।

করণীয় ২: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমাজে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা: বহু বছর দলীয়করণ ও সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে আমাদের ক্যাম্পাস ও সমাজে গণতান্ত্রিক চর্চা দুর্বল হয়েছে। ভবিষ্যতে ছাত্রসমাজের একটি বড় করণীয় হবে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে এবং আশেপাশের কমিউনিটিতে গণতন্ত্রের চর্চা ফিরিয়ে আনা। এর অর্থ হলো নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন, বিতর্ক ও মতবিনিময়ের পরিবেশ তৈরি, এবং ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা গড়ে তোলা। আজ যারা আন্দোলনকারী, কাল তাদের মধ্য থেকেই অনেকে নেতৃত্বে আসবে – সেজন্য গণতন্ত্রের মূল্যবোধে দীক্ষিত হওয়া জরুরি। ক্লাসরুমে, হল ও ইউনিভার্সিটি ক্লাবে আলোচনা, মুক্তচিন্তার চর্চা, নির্বাচিত প্রতিনিধি দিয়ে সমস্যার সমাধান – এসব উদ্যোগ তরুণদের নিতে হবে যাতে তৃণমূল থেকে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এভাবে সামগ্রিক সমাজেও জবাবদিহিতা ও অংশগ্রহণের চেতনা বিস্তৃত হবে।

করণীয় ৩: প্রযুক্তি যোগাযোগের যথাযথ ব্যবহার: আধুনিক যুগে সোশ্যাল মিডিয়া ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তরুণদের জন্য শক্তিশালী হাতিয়ার। ভবিষ্যতে ছাত্র-জনতা এই মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করে জনমত গঠন তথ্যছড়িয়ে দেওয়ার কাজ চালিয়ে যেতে পারে। তবে কর্তৃপক্ষ আগে যে আইন দিয়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল (DSA/CSA), তা মাথায় রেখে সতর্কভাবে এগোতে হবে। গঠনমূলক সমালোচনা ও সচেতনতামূলক কনটেন্ট তৈরির মাধ্যমে জনগণকে সক্রিয় রাখা এবং যে কোনো গুজব বা ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোও তরুণদের দায়িত্ব। দেশের বাস্তব সমস্যাগুলো (যেমন বেকারত্ব, শিক্ষা মান, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ) নিয়ে অনলাইন ক্যাম্পেইন চালিয়ে তারা সরকার ও নীতিনির্ধারকদের ক্রমাগত অবগত রাখতে পারে। আগের আন্দোলনগুলোতেও আমরা দেখেছি, ফেসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমে দ্রুত খবর ছড়িয়ে শিক্ষার্থীরা সংগঠিত হয়েছে। ভবিষ্যতেও এই ধারা জারি রেখে প্রযুক্তিকে সামাজিক পরিবর্তনের শক্তিতে রূপান্তর করতে হবে।

করণীয় ৪: আন্তর্জাতিক সংযোগ অভিজ্ঞতা বিনিময়: বাংলাদেশের তরুণরা এখন বিশ্বমনস্ক; তাই গণতন্ত্র ও ন্যায্যতার আন্দোলনে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংহতি গড়ে তোলাও একটি করণীয় দিক। প্রতিবেশী দেশগুলো ও বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে এবং অন্যদের অভিজ্ঞতা থেকে শিখে আমাদের আন্দোলনকে সমৃদ্ধ করা যায়। ইতোমধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে এবং জরুরি সংস্কারের আহ্বান করেছে। ভবিষ্যতে এই সম্পর্কগুলো কাজে লাগিয়ে তরুণরা একটি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারে, যা কোনো সংকটে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে সহায়ক হবে। উদাহরণস্বরূপ, জাতিসংঘের তরুণ প্রতিনিধি প্রোগ্রাম বা এশিয়ার অন্যান্য দেশের ইয়ুথ অ্যাক্টিভিস্টদের সম্মেলনে অংশ নিয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময় করা যেতে পারে। এতে দেশের ভেতরে আন্দোলন আরও দক্ষ ও কৌশলী হবে এবং বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও ইতিবাচক হবে।

সম্ভাব্য ফলাফল: যদি উপরোক্ত পদক্ষেপগুলো সফলভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে আমরা এমন একটি বাংলাদেশ পেতে পারি যেখানে:

  • গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে: নিয়মিত অবাধ নির্বাচন, শক্তিশালী সংসদ এবং স্বাধীন বিচার বিভাগসহ একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সরকার পরিবর্তন হবে শান্তিপূর্ণ ভোটের মাধ্যমে, এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত হবে।
  • আইনের শাসন ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে: প্রশাসন, পুলিশ ও আদালত রাজনৈতিক চাপমুক্ত থেকে তাদের কাজ করবে। মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি বা অপরাধের ক্ষেত্রে দ্রুত বিচার সম্পন্ন হবে এবং সাধারণ নাগরিক আইনের প্রতি আস্থা ফিরে পাবে। দীর্ঘদিনের দণ্ডহীনতার সংস্কৃতি ভেঙে পড়বে।
  • সামাজিক ভারসাম্য সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে: সবার জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা, এলাকার ভিত্তিতে সমান উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষিত হবে। এতে সামাজিক স্থিতিশীলতা আসবে এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে, যার সুফল সবাই ভোগ করতে পারবে।
  • নতুন নেতৃত্বের উদয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হবে: আজকের আন্দোলনকারী তরুণদের মধ্য থেকেই আগামী দিনের রাজনীতিক, সংসদ সদস্য ও নীতি-নির্ধারক তৈরি হবেন, যারা পুরনো বিপথগামী রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে জনকল্যাণে কাজ করবেন। রাজনীতিতে যুবকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে এবং আদর্শনিষ্ঠ রাজনীতির চর্চা দেখা যাবে।
  • বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা উজ্জ্বল হবে: গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে গেলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উন্নত হবে। বিদেশি বিনিয়োগ ও সহযোগিতা বাড়বে, প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশিরাও গর্ব অনুভব করবেন। একটি উন্নত, গণতান্ত্রিক “সোনার বাংলা” গড়ার স্বপ্ন বাস্তব রূপ পেতে শুরু করবে, যা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নেরও প্রতিফলন।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২০২৪

অবশ্য এ পথ মসৃণ নয়, এবং ফলাফল আসতে সময় লাগবে। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, স্বৈরতান্ত্রিক শাসন শেষ হলেও গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হতে বাধা এসেছে, আবার পুরনো শক্তি ফিরে আসার আশঙ্কাও থাকে। তাই ভবিষ্যতে তরুণদের সতর্ক থাকতে হবে যে তারা যে পরিবর্তন এনে দিচ্ছে তা যেন স্থায়ী হয়। আশার কথা, এবারের তরুণদের আন্দোলন কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে – অন্তর্বর্তী সরকারের পরামর্শক পরিষদে ছাত্রনেতাদের রাখা ইত্যাদি উদ্যোগ ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক সংকেত। এটি দীর্ঘমেয়াদে একটি শক্তিশালী গণতন্ত্র নির্মাণে সহায়তা করতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এখন আত্মবিশ্বাস দায়িত্ববোধ দুটোই স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। তারা শুধু স্বপ্ন দেখেই ক্ষান্ত নয়, স্বপ্নগুলো পূরণে সাহসী পদক্ষেপ নিচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে এবং সমাজের অন্যান্য অংশ তাদের পাশে থাকলে, অদূর ভবিষ্যতে আমরা একটি ন্যায়পরায়ণ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দেখতে পাব – যেখানে তারুণ্যের স্বপ্ন সত্যিই বাস্তবায়িত হবে। দেশপ্রেম, ঐক্য ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তরুণ ছাত্র-জনতাই পারবে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে দিতে।


Share.
Leave A Reply

error: Content is protected !!
Exit mobile version