প্রস্তাবনা: কোয়ান্টাম কম্পিউটিং (Quantum Computing) এমন এক ভবিষ্যতমুখী কম্পিউটিং প্রযুক্তি যা ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে জটিল সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি নিয়ে প্রযুক্তি জগতে তুমুল আলোচনা চলছে — ধারণা করা হয় কোয়ান্টাম কম্পিউটার ওষুধ আবিষ্কার, মেশিন লার্নিং থেকে শুরু করে যোগাযোগ নিরাপত্তা পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম, এমনকি বর্তমান ক্রিপ্টোগ্রাফি বা এনক্রিপশন ভেঙে ফেলতেও পারবে। IBM, Google, Microsoft-এর মতো শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানি এবং বিভিন্ন সরকার (যেমন চীন) কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর গবেষণা ও উন্নয়নে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। ২০১৯ সালে Google প্রথমবারের মতো দাবি করে যে তাদের ৫৩-কিউবিটের কোয়ান্টাম প্রসেসর “কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি” অর্জন করেছে – অর্থাৎ একটি সমস্যা সমাধানে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ক্লাসিক্যাল সুপারকম্পিউটারকেও ছাড়িয়ে গেছে। এই ব্লগে আমরা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর মূল ধারণা ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি থেকে শুরু করে এটির ইতিহাস, গুরুত্বপূর্ণ কোয়ান্টাম এলগরিদম, বর্তমান অর্জন (Quantum Supremacy সহ) এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিশদ বিশ্লেষণ করবো।
ব্লগের কাঠামো: প্রথমে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং কী এবং কীভাবে এটি কাজ করে তা আলোচনা করবো, যেখানে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের সাথে এর মূল পার্থক্যগুলো ব্যাখ্যা করা হবে। এরপর কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মূল উপাদান যেমন সুপারপজিশন ও এনট্যাংলমেন্ট এবং কিউবিট-এর ভূমিকা বুঝবো। শোরের অ্যালগরিদম, গ্রোভার্স অ্যালগরিদমের মতো অগ্রগণ্য কোয়ান্টাম এলগরিদমগুলোর উদাহরণ দিয়ে দেখাবো কেন এগুলো গুরুত্বপূর্ণ। তারপর Quantum Supremacy বা কোয়ান্টাম শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা এবং সাম্প্রতিক সময়ে এ নিয়ে কী কী অগ্রগতি হয়েছে তা তুলে ধরবো। পাশাপাশি Google, IBM, Intel, Microsoft ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক গবেষণা ও কোয়ান্টাম হার্ডওয়্যার উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা থাকবে। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের বাস্তব kullanımক্ষেত্র যেমন ক্রিপ্টোগ্রাফি, ওষুধ আবিষ্কার, মেটেরিয়াল সায়েন্সে এর সম্ভাবনা পর্যালোচনা করবো। পরে বর্তমান চ্যালেঞ্জ – বিশেষ করে কোয়ান্টাম ত্রুটি সংশোধন, স্কেলিং সমস্যা ও ডিকোহারেন্স – নিয়ে কথা বলবো। সর্বশেষে কোয়ান্টাম ইন্টারনেট, কোয়ান্টাম সিকিউরিটি এবং টপোলজিকাল কিউবিটের মতো ভবিষ্যৎ দিগন্তের দিকে নজর দেবো। চলুন শুরু করা যাক।
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর মূল ধারণা ও ভিত্তি
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর ধারণার উন্মেষ ঘটে ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে। ১৯৮২ সালে কিংবদন্তি পদার্থবিদ রিচার্ড ফেইনম্যান লক্ষ করেন যে প্রকৃতি নিজেই কোয়ান্টাম-সুলভ, তাই প্রকৃতির সঠিক সিমুলেশন করতে চাইলে আমাদের কম্পিউটারও কোয়ান্টাম আইন মেনে চলা উচিত। সহজভাবে বললে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার এমন একটি যন্ত্র যা পার্টিকলের মতো ক্ষুদ্র উপপরমাণবিক কণা এবং তাদের তরঙ্গ-ধর্মী বৈশিষ্ট্য (যেমন সুপারপজিশন, এনট্যাংলমেন্ট) ব্যবহার করে ডেটা প্রসেস করে। এই ভাবনাটি প্রথম প্রস্তাব করেন ফেইনম্যান, যিনি বলেছিলেন “প্রকৃতি ক্লাসিক্যাল নয়, সুতরাং প্রকৃতিকে সিমুলেট করতে কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যবহার করাই উত্তম”। এই ধারণাই কোয়ান্টাম কম্পিউটিং গবেষণার বীজ বপন করে।
এর কয়েক বছর পর ১৯৮৫ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিড ডয়েচ এক ধাপ এগিয়ে “ইউনিভার্সাল কোয়ান্টাম কম্পিউটার”-এর তাত্ত্বিক মডেল প্রকাশ করেন। ডয়েচ দেখান যে একটি কোয়ান্টাম সিস্টেম তাত্ত্বিকভাবে ক্লাসিক্যাল টুরিং মেশিনের মতো যেকোনো গণনাযোগ্য সমস্যা সমাধানে সক্ষম হতে পারে, তবে এটি কাজ করবে সম্পূর্ণ কোয়ান্টাম রাজ্যে। এই প্রস্তাবনা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ভিত্তিকে মজবুত করে এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অদ্ভূত টেকনিককে কাজে লাগিয়ে নতুন ধরনের কম্পিউটেশনাল ক্ষমতা অর্জন সম্ভব।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মূল গাঠনিক একক হলো “কিউবিট” (qubit), যা ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের বিটের কোয়ান্টাম সংস্করণ। প্রতিটি কিউবিট একই সাথে একাধিক অবস্থা ধারণ করতে পারে (সুপারপজিশন), ফলে কোয়ান্টাম কম্পিউটার নির্দিষ্ট অবস্থায় থাকাকালীন অসংখ্য সমীকরণ বা গণনা সমান্তরালে সম্পন্ন করতে পারে – যাকে জনপ্রিয়ভাবে বলা হয় “কোয়ান্টাম সমান্তরালতা”। এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত আসছে, তবে মূল ধারণাটি হচ্ছে যে কোয়ান্টাম ব্যাখ্যান (interpretation) অনুযায়ী কোনও সিস্টেমকে একাধিক সম্ভাব্য অবস্থার সুপারপজিশনে রাখা যায় এবং পর্যবেক্ষণের আগ পর্যন্ত এটি একই সাথে সবগুলো অবস্থায় “অবস্থান” করে থাকে।
১৯৯০-এর দশকে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ধারণার বাস্তব গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে কয়েকটি অনন্য অ্যালগরিদমের আবিষ্কারের মাধ্যমে, যা আমরা পরের অংশে আলোচনা করবো। তারও আগে, ক্লাসিক্যাল বনাম কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মধ্যে পার্থক্যগুলি সংক্ষেপে দেখা যাক।
ক্লাসিকাল কম্পিউটারের তুলনায় কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পার্থক্য
ক্লাসিক্যাল (ধারাবাহিক) বনাম কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর পার্থক্য বোঝার জন্য বিট এবং কিউবিটের তফাৎটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারে বিট হলো প্রাথমিক তথ্যধারণ ইউনিট, যা দ্বি-মূল্য (বাইনারি) – একটি বিট হয় ০ (বন্ধ) অথবা ১ (চালু) অবস্থায় থাকতে পারে। অন্যদিকে কিউবিট এক সময়ে ০ এবং ১ দুই অবস্থার সুপারপজিশনে থাকতে পারে। অর্থাৎ, একটি কিউবিটকে আমরা একই সঙ্গে “০-১ দুইটাই” হিসেবে ভাবতে পারি, যতক্ষণ না সেটি মাপা (measure) হচ্ছে। এই ক্ষমতার ফলেই কিউবিট একই সাথে বহু গণনা পরিচালনা করতে পারে, যেখানে ক্লাসিক্যাল বিটকে এক সময়ে একটিমাত্র মানেই (০ বা ১) সীমাবদ্ধ থাকতে হয়। সহজ ভাষায়, ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারে একটি বিট একসঙ্গে একটিমাত্র গণনা সম্পন্ন করতে পারে, আর কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কিউবিট সুপারপজিশনের কারণে একসঙ্গে বহুগুণ বেশি গণনা করতে পারে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হল কোয়ান্টাম এনট্যাংলমেন্ট বা জড়তা, যা দুই বা ততোধিক কিউবিটকে এমনভাবে সম্পর্কযুক্ত করে যে তাদের অবস্থা পৃথক হলেও একটি কিউবিটের মান পরিমাপ করলে অন্যগুলোর মান সঙ্গে সঙ্গে নির্ধারিত হয়ে যায় (তারা দূরে অবস্থান করলেও)। এনট্যাংলমেন্টের ফলে কিউবিটসমূহের মধ্যে এক ধরনের সমন্বিত অবস্থা তৈরি হয়, যা ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারে অর্জন করা অসম্ভব। এর ফলস্বরূপ কোয়ান্টাম কম্পিউটার এমন কিছু অপারেশন করতে পারে যেখানে একাধিক কিউবিট মিলিয়ে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ হয় অত্যন্ত দক্ষ উপায়ে। উদাহরণস্বরূপ, ২টি এনট্যাঙ্গল্ড কিউবিটের যৌথ অবস্থা ৪টি ক্লাসিক্যাল বিটের সমতুল্য তথ্য বহন করতে পারে, ৩টি কিউবিট ৮ বিটের সমতুল্য ইত্যাদি – সংক্ষেপে, $n$ সংখ্যক কিউবিট একসাথে এনট্যাংলড অবস্থায় $2^n$ সম্ভাব্য অবস্থার সুপারপজিশন ধারণ করতে সক্ষম। এই স্কেলিং এর কারণে খুব অল্প সংখ্যক কিউবিট দিয়েই বিপুল পরিমাণ সম্ভাব্য কম্পিউটেশনাল অবস্থা একযোগে উপস্থাপন করা যায়, যা ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারে কল্পনাতীত।
তবে মনে রাখতে হবে, ক্লাসিক্যাল এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পার্থক্য যতটাই শক্তিশালী হোক না কেন, কোয়ান্টাম কম্পিউটার সব কাজে ক্লাসিক্যালকে হারাতে পারবে এমন নয়। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং বিশেষ কিছু সমস্যায় অসাধারণ দ্রুতগতি দেখাবে (যেমন বড় সংখ্যা ফ্যাক্টরাইজেশন বা অসীম সম্ভাবনার মধ্যে সন্ধান করা), তবে অনেক সাধারণ কম্পিউটিং কাজ (যেমন সাধারণ গাণিতিক অপারেশন, ডকুমেন্ট এডিটিং ইত্যাদি) ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের জন্যই উপযুক্ত থাকবে। অর্থাৎ, কোয়ান্টাম সুপিরিয়রিটি নির্ভর করবে সমস্যার প্রকৃতির উপর। পরবর্তীতে আমরা Quantum Supremacy অংশে উদাহরণসহ দেখবো কোয়ান্টাম কম্পিউটার কোন ক্ষেত্রগুলোতে প্রকৃতপক্ষে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করছে।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং কিউবিট-এর ভূমিকা
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের হৃদয় হল কিউবিট, যা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নীতিমালা মেনে চলে। একেকটি কিউবিট বাস্তব জগতে বিভিন্ন রূপে বাস্তবায়ন করা যায় – এটমের স্পিন-অবস্থা, ফোটনের পোলারাইজেশন, সুপারকন্ডাক্টিং ইলেকট্রিক সার্কিটে বৈদ্যুতিক প্রবাহের দশা, বা আইয়ন ট্র্যাপে বন্দী একক পরমাণুর অবস্থা ইত্যাদি হতে পারে কিউবিটের ফিজিক্যাল ক্যারিয়ার। প্রতিটি কিউবিটের জন্য থাকে দুটি আধার (বেসিস) অবস্থা, সাধারণত |0〉 এবং |1〉, যা কোয়ান্টাম সংশ্লিষ্ট দুটি ভিন্ন অবস্থাকে নির্দেশ করে (যেমন ইলেকট্রনের স্পিন আপ = |0〉, স্পিন ডাউন = |1〉)। কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুসারে কিউবিট কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে |0〉 অথবা |1〉 নয়, বরং তা |0〉 এবং |1〉 এর একটি সম্ভাবনামূলক মিলিত অবস্থা (সুপারপজিশন) হতে পারে:
∣ψ〉=α∣0〉+β∣1〉,|\psi〉 = \alpha |0〉 + \beta |1〉,
যেখানে $\alpha$ এবং $\beta$ হলো কমপ্লেক্স সংখ্যা এবং $|\alpha|^2 + |\beta|^2 = 1$। অর্থাৎ, পর্যবেক্ষণের (মাপার) আগ পর্যন্ত কিউবিট অবস্থা $|\psi〉$-কে একযোগে 0 এবং 1 এর লিনিয়ার কম্বিনেশন হিসেবে বিবেচনা করতে হয়, $\alpha$ এবং $\beta$ যথাক্রমে 0 বা 1 ফলাফল পাওয়ার প্রায় সম্ভাবনা নির্দেশ করে।
কিউবিটের এই সুপারপজিশন-কে চিত্রায়িত করতে পদার্থবিদরা Bloch Sphere নামে ত্রিমাত্রিক গোলক আকৃতির একটি চিত্র ব্যবহার করে থাকেন। Bloch গোলকের উত্তর ও দক্ষিণ মেরু সাধারণত |0〉 এবং |1〉 ভিত্তিস্থিতিকে প্রকাশ করে, এবং গোলকের পৃষ্ঠের অন্যান্য বিন্দুসমূহ বিভিন্ন সম্ভাব্য সুপারপোজড কোয়ান্টাম অবস্থা নির্দেশ করে। নিচের চিত্রে একটি Bloch Sphere দেখানো হলো, যেখানে নীল (H এবং V), লাল (A, D) ও সবুজ (R, L) চিহ্নগুলো ভিন্ন ভিন্ন ভিত্তি-অবস্থা নির্দেশ করছে:
Bloch Sphere: একটি কিউবিটের কোয়ান্টাম অবস্থার জ্যামিতিক উপস্থাপন। গোলকের পৃষ্ঠের প্রতিটি বিন্দু একটি সম্ভাব্য কিউবিট-অবস্থা বোঝায়; লাল, সবুজ ও নীল তীরগুলো বিভিন্ন ভিত্তি ও প্রান্তিক অবস্থা (উদাহরণ: |0〉, |1〉 ও তাদের সুপারপজিশন) নির্দেশ করছে।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আরেকটি আশ্চর্যজনক বৈশিষ্ট্য এনট্যাংলমেন্ট (জড়তা) আগেই আলোচিত হয়েছে। এতে দুটি কিউবিটকে এমনভাবে প্রস্তুত করা হয় যে তাদের যৌথ অবস্থা আলাদা করেও বর্ণনা করা যায় না – একটির পরিমাপ ফলাফল সাথে সাথে অন্যটির ফল নির্ধারণ করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, দুটি এনট্যাঙ্গল্ড কিউবিটকে এই ধরনের অবস্থায় রাখা যেতে পারে:
∣ψ12〉=12(∣0〉1∣0〉2+∣1〉1∣1〉2),|\psi_{12}〉 = \frac{1}{\sqrt{2}}\big(|0〉_1|0〉_2 + |1〉_1|1〉_2\big),
যা Bell State নামে পরিচিত। এখানে কিউবিট 1 এবং 2 একই সাথে 00 এবং 11 অবস্থার সুপারপজিশনে রয়েছে। আপনি যদি প্রথম কিউবিটটি পরিমাপ করেন এবং 0 পান, নিশ্চিতভাবেই দ্বিতীয়টিও 0 হবে; প্রথমটি 1 হলে দ্বিতীয়টিও 1 হবে – যদিও পরিমাপের পূর্বে তারা 0/1 এর মিশ্রণে ছিল। এই জড়তা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের এমন সমন্বিত তথ্যপ্রক্রিয়ার দ্বার উন্মোচন করে যা ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারে অর্জন করা যায় না।
এখানে এটাও জোর দেওয়া দরকার যে কিউবিট অনেক স্পর্শকাতর। পরিবেশের সামান্য বিচ্যুতি (তাপ, শব্দ, কম্পন ইত্যাদি) কিউবিটের কোয়ান্টাম অবস্থা নষ্ট করে দিতে (ডিকোহিয়ার) পারে। এজন্য অধিকাংশ কোয়ান্টাম হার্ডওয়্যারকে অতি নিম্ন তাপমাত্রায় (মহাবিশ্বের সবচেয়ে শীতল স্থানগুলোর কাছাকাছি, যেমন ১০ মিলিকেলভিন) রাখতে হয় এবং শক্তিশালী আইসোলেশন (নিরোধ) প্রয়োজন হয়। সুপারকন্ডাক্টিং কিউবিটের জন্য বিশেষত ডাইলিউশন রেফ্রিজারেটর নামক অত্যন্ত ঠাণ্ডা করা ফ্রিজ ব্যবহার করা হয়, যার ভিতরে স্তরীকৃত এক জটিল “ঝাড়বাতি” আকৃতির কাঠামোতে কিউবিটসমূহ স্থাপন করা থাকে।
IBM-এর সুপারকন্ডাক্টিং কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ডাইলিউশন রেফ্রিজারেটরের ভিতরের চিত্র। এই স্তরযুক্ত সোনালি “চ্যান্ডেলিয়ার” কাঠামোটি কোয়ান্টাম প্রসেসর ও সংযুক্ত কিউবিটগুলোকে অতি-নিম্ন তাপমাত্রা (প্রায় ১০–১৫ মিলিকেলভিন) পর্যন্ত ঠান্ডা করে স্থিতিশীল রাখে । কোয়ান্টাম কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার অনেকটাই আলাদা ও জটিল, যা এই ছবিতে দৃশ্যমান।
উপরের ছবিতে দেখা এই জটিলযন্ত্রের মাধ্যমে কিউবিটগুলোকে পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন ও ঠাণ্ডা রাখা হয়, যাতে তারা সুপারপজিশন ও এনট্যাংলমেন্ট স্থায়ীভাবে বজায় রাখতে পারে। এটি বুঝতে পারা যায় যে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের প্রকৃত হার্ডওয়্যার দেখতে প্রচলিত সিলিকন মাইক্রোচিপ ভিত্তিক কম্পিউটারের থেকে একদম ভিন্ন — অনেকটা যেন সায়েন্স ফিকশনের স্টিমপাঙ্ক যন্ত্রপাতি!
কোয়ান্টাম এলগরিদম: Shor’s Algorithm, Grover’s Algorithm ইত্যাদি
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সম্ভাব্য শক্তিমত্তা প্রকটভাবে প্রকাশ পায় ১৯৯০-এর দশকে আবিষ্কৃত কয়েকটি অ্যালগরিদমের মাধ্যমে, যেগুলো ক্লাসিক্যাল অ্যালগরিদমের তুলনায় বিশাল কর্মদক্ষতা প্রদর্শন করে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ দুটি হল শোরের অ্যালগরিদম (Shor’s Algorithm) এবং গ্রোভার্স অ্যালগরিদম (Grover’s Algorithm)।
Shor’s Algorithm (শোরের অ্যালগরিদম): ১৯৯৪ সালে গণিতবিদ পিটার শোর একটি কোয়ান্টাম অ্যালগরিদম উদ্ভাবন করেন যা বড় সংখ্যাকে তার মৌলিক গুণনীয়কে (ফ্যাক্টর) ভাঙতে অসাধারণ দ্রুতগতিসম্পন্ন (দ্রুততর) পদ্ধতি প্রদান করে। সাধারণ কম্পিউটারে বড় সংখ্যাকে (যেমন ৩০০-ডিজিটের সংখ্যা) মৌলিক গুণনীয়কে ভাঙা বর্তমানের সর্বোত্তম অ্যালগরিদমের জন্য প্রায় অবাস্তবসম (‘sub-exponential’ সময় লাগে) সময় নিতে পারে, যা আধুনিক ক্রিপ্টোগ্রাফির (RSA এনক্রিপশনের) নিরাপত্তার মূল ভিত্তি। কিন্তু শোরের অ্যালগরিদম কোয়ান্টাম কম্পিউটারে পলিনোমিয়াল সময়ে এই কাজটি করে ফেলতে পারে। সহজভাবে বললে, যদি পর্যাপ্ত সংখ্যক ত্রুটিহীন কিউবিট হাতে থাকে, শোরের অ্যালগরিদম ব্যবহার করে আজকের প্রচলিত RSA-2048 এনক্রিপশনকে মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে ফেলা সম্ভব! এই কারণে শোরের অ্যালগরিদমই প্রথম ব্যাপকভাবে সকলের নজর কাড়ে এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর ক্রিপ্টোগ্রাফি-বিপ্লব ঘটানোর সক্ষমতা সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করে। ২০০১ সালে IBM-এর বিজ্ঞানীরা প্রথম ছোট স্কেলের একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটারে শোরের অ্যালগরিদম চালিয়ে ১৫ এর মৌলিক গুণনীয়ক (৩ এবং ৫) সফলভাবে বের করেন, যদিও সেটি ছিল মাত্র ৭-কিউবিটের সিস্টেম (মূলত প্রমাণস্বরূপ একটি মাইলফলক)।
Grover’s Algorithm (গ্রোভার্স অ্যালগরিদম): ১৯৯৬ সালে লাভ গ্রোভার নামে বিজ্ঞানী একটি কোয়ান্টাম অনুসন্ধান অ্যালগরিদম প্রস্তাব করেন যা অব্যবস্থিত (অনস্ট্রাকচার্ড) ডেটাবেস বা তালিকায় লক্ষ্য উপাদান খুঁজে বের করতে ক্লাসিক্যাল যে কোনও অ্যালগরিদমের তুলনায় তাত্ত্বিকভাবে ত্রুটি-বিহীনভাবে $\sqrt{N}$ (স্কোয়ার্ট-রুট) মাত্রার কম সময়ে ফল দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যেথানে ক্লাসিক্যাল কোনো অনুসন্ধান অ্যালগরিদমের গড়ে $N/2$ ধাপে উত্তর পাওয়ার কথা, সেখানে গ্রোভার্স অ্যালগরিদম মাত্র প্রায় $\sqrt{N}$ ধাপে ফলাফল দিতে পারবে। যদিও এটি শোরের মতো “এক্সপোনেনশিয়াল স্পিডআপ” দেয় না, তবু ডাটাবেস অনুসন্ধান, অ্যানালগ সমীকরণের সলভার, বা অপ্টিমাইজেশনের মতো কাজে এটি গুরুত্বপূর্ণ কোয়ান্টাম প্রবৃদ্ধি (quadratic speedup) সরবরাহ করে।
এই দুইটি উদাহরণ ছাড়াও কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ে আরও নানান ধরনের অ্যালগরিদম রয়েছে – যেমন সিমন’স অ্যালগরিদম, ডয়েচ–জোজা অ্যালগরিদম, কোয়ান্টাম ফোরিয়ার ট্রান্সফর্ম ইত্যাদি – যেগুলো নির্দিষ্ট নির্দিষ্ট সমস্যায় কোয়ান্টাম কম্পিউটারের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। এছাড়া সেট লয়েড ১৯৯৬ সালে দেখান যে কোয়ান্টাম কম্পিউটার কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিজস্ব সিস্টেমগুলোকেই সরাসরি সিমুলেট করতে পারবে, যেটি ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারে অত্যন্ত দুরূহ কাজ। এভাবে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং গবেষণার শুরুতেই তাত্ত্বিকভাবে নিশ্চিত হয়ে যায় যে কিছু কিছু সমস্যায় এর জন্য বিশেষভাবে তৈরি এলগরিদম ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের তুলনায় গুণগতভাবে অনেক বেশি কার্যকর।
Quantum Supremacy-এর ধারণা ও বর্তমান অগ্রগতি
কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ে Quantum Supremacy বা কোয়ান্টাম শ্রেষ্ঠত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলকস্বরূপ ধারণা। ২০১২ সালে ক্যালটেকের পদার্থবিদ জন প্রেসকিল “Quantum Supremacy” পরিভাষাটি চালু করেন এই অর্থে যে – কোয়ান্টাম কম্পিউটার এমন একটি কাজ সম্পন্ন করবে যা কোনও ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার বাস্তবে করে দেখাতে পারবে না। প্রেসকিল এই শব্দ দ্বারা বোঝাতে চেয়েছিলেন সেই মুহূর্তকে, যখন কোয়ান্টাম সিস্টেমের ক্ষমতা ক্লাসিক্যালের সীমা অতিক্রম করবে)। এটি অবশ্যই একটি তুলনামূলক ধারণা – কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি অর্জনের অর্থ এই নয় যে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ক্লাসিক্যালকে সর্বক্ষেত্রে হারিয়ে দিল, বরং খুব নির্দিষ্ট কোন কাজ বা সমস্যায় তাদের অতিক্রম করলো।
২০১৯ সালে Google প্রথম ঘোষণা দেয় যে তারা Quantum Supremacy অর্জন করেছে। গুগলের কোয়ান্টাম কম্পিউটিং বিভাগের গবেষকরা Sycamore নামের ৫৩-কিউবিটের সুপারকন্ডাক্টিং কোয়ান্টাম প্রসেসর ব্যবহার করে একটি বিশেষ কর্ম (random circuit sampling) সম্পন্ন করেন, যা তাদের দাবি অনুযায়ী বিশ্বের শক্তিশালীতম ক্লাসিক্যাল সুপারকম্পিউটারকেও করতে ১০,০০০ বছর সময় লেগে যেত, সেখানে Sycamore মাত্র ২০০ সেকেন্ডে তা করে দেখিয়েছে। এই ফলাফলকে তারা Nature জার্নালে প্রকাশ করেন এবং এটিই ইতিহাসে প্রথম কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসির দাবীকৃত সাফল্য হিসেবে পরিচিত। অবশ্য IBM সহ কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান গুগলের দাবির কিছুটা সমালোচনা করেছিল – IBM থেকে দাবি ওঠে যে সুপারকম্পিউটারকে কিছু কৌশল খাটিয়ে হয়তো কয়েকদিন বা কয়েকঘণ্টায়ও সেই কাজ করানো সম্ভব ছিল, তাই “সুপ্রিমেসি” শব্দটি অতিরঞ্জিত হতে পারে। তবে একেবারে নির্বিশেষভাবে যদি বিচার করি, গুগলের পরীক্ষাটি প্রমাণ করে যে বাস্তব হার্ডওয়্যারসহ কোয়ান্টাম কম্পিউটার এমন একটি স্তরে পৌঁছে গেছে যেখানে অন্তত একটি নির্দিষ্ট কাজের জন্য তারা ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। এটি কোয়ান্টাম কম্পিউটিং উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক বড় মাইলফলক।
গুগলের পর ২০২০-২১ সালে চীনের গবেষকরা ফোটনিক কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার করে Boson Sampling সমস্যা সমাধানে কোয়ান্টাম শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের দাবি করেন। তাদের নির্মিত যন্ত্র (জিয়ুঝাং নামক ফোটনিক কুইয়ান্টাম প্রসেসর) ৭৬-ফোটন সংবলিত বোসন স্যাম্পলিং টাস্ক সম্পন্ন করে, যা তারা হিসেব করে দেখে যে বিশ্বের কোন সুপারকম্পিউটারেও বাস্তবসম্মত সময়ে করা সম্ভব নয়। এভাবেও কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসির আরো কিছু উদাহরণ তৈরি হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে।
কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি অর্জনের মানে এই নয় যে সেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার সাথে সাথেই সকল কার্যক্রমে ব্যবহার করা যাবে। বাস্তবে, গুগলের Sycamore প্রসেসর যে কাজে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে সেটি একটি নির্দিষ্ট এলোমেলো কোয়ান্টাম সার্কিটের আউটপুট স্যাম্পলিং; এই কাজটির তাত্পর্য এই যে এটি কোনও বাস্তব জটিল সমস্যা সমাধান নয়, বরং কোয়ান্টাম ও ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের ক্ষমতার তুলনা করার জন্য নকশা করা একটি পরীক্ষামাত্র। তবে সাম্প্রতিক প্রক্ষেপণগুলো বলছে আমরা দ্রুতই আরও অর্থবহ কাজে কোয়ান্টাম শ্রেষ্ঠত্ব দেখতে পাবো। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে Google তাদের Sycamore প্রসেসর উন্নীত করে ৭০-কিউবিটে উন্নীত করেছে এবং জানিয়েছে যে একটি নতুন কোয়ান্টাম সার্কিট সিমুলেশন তারা চালিয়েছে যা বর্তমান ক্লাসিক্যাল সুপারকম্পিউটার Frontier-এর তুলনায় লক্ষগুণ দ্রুত সম্পন্ন হয়েছে। গবেষকদের হিসাবে, এই বিশেষ কাজটি ক্লাসিক্যাল সুপারকম্পিউটারে ~৪৭ বছর সময় নিত, কিন্তু Sycamore-৭০ মাত্র কয়েক সেকেন্ডে করেছে। এই ধরণের অগ্রগতি নির্দেশ করে যে আমরা কেবল শুরুতেই রয়েছি – বাস্তব সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রেও কোয়ান্টাম কম্পিউটার শীঘ্রই কার্যকরিতা দেখাতে পারে।
ভিডিও পরামর্শ: Quantum Supremacy সংক্রান্ত এই ঐতিহাসিক Google’s Sycamore পরীক্ষাটি বুঝতে চাইলে Google Quantum AI দলের প্রকাশিত “Demonstrating Quantum Supremacy” শিরোনামের ইউটিউব ভিডিওটি দেখা যেতে পারে, যেখানে তাদের অর্জন ও এর গুরুত্ব সরলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এছাড়া WIRED Explains সিরিজের “Quantum computing and quantum supremacy, explained” ভিডিওতেও Quantum Computing-এর মূল ধারণা ও Google-এর ২০১৯ সালের সুপ্রিমেসি দাবির প্রেক্ষাপট সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এগুলো দেখতে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও সুপ্রিমেসির ধারণাগুলো আরও স্পষ্ট হবে।
গুগল, IBM, Intel, Microsoft-এর সাম্প্রতিক গবেষণা ও কোয়ান্টাম হার্ডওয়্যার উন্নয়ন
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে নানা প্রতিষ্ঠান কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির প্রতিযোগিতায় নেমেছে। গুগল, আইবিএম, ইন্টেল ও মাইক্রোসফট – এদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন কৌশল ও সাফল্য রয়েছে কোয়ান্টাম হার্ডওয়্যারে। নিচে সংক্ষিপ্তভাবে তাদের সাম্প্রতিক উদ্যোগ ও অগ্রগতি তুলে ধরা হলো:
- Google (গুগল): গুগল তাদের কোয়ান্টাম গবেষণা শুরু করে ক্যালিফোর্নিয়ার UCSB-এর গবেষকদের নিয়ে দল গঠন করে। তারা মূলত সুপারকন্ডাক্টিং ট্রান্সমন কিউবিট প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। ২০১৮ সালে গুগল একটি ৭২-কিউবিটের চিপ (Bristlecone) উন্মোচন করে, যদিও তা পূর্ণাঙ্গরূপে ব্যবহার হয়নি। ২০১৯ সালে তাদের ৫৪-কিউবিটের Sycamore প্রসেসর (যার ৫৩টি কিউবিট সক্রিয় ছিল) কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি অর্জন করে বিখ্যাত হয়। পরবর্তীতে গুগল ৭০-কিউবিট পর্যন্ত স্কেল বাড়িয়েছে এবং কোয়ান্টাম ত্রুটি সংশোধনের উপর গবেষণায় মনোনিবেশ করেছে। তাদের লক্ষ্য হলো দশকের মধ্যেই (প্রায় ২০২৯ সালের মধ্যে) একটি কার্যকরী ত্রুটি-সংশোধিত কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানো, যা বাস্তব সমস্যার সমাধানে ব্যবহৃত হবে। গুগল Quantum AI সম্প্রতি “Willow” নামে একটি নতুন চিপ উন্নয়ন করছে যাতে স্কেল বাড়লেও ত্রুটি হার কমানো যায়। হার্ডওয়্যার অগ্রগতির পাশাপাশি গুগল সোর্স Cirq নামের একটি কোয়ান্টাম প্রোগ্রামিং লাইব্রেরিও তৈরি করেছে ডেভেলপারদের জন্য।
- IBM (আইবিএম): IBM কোয়ান্টাম কম্পিউটিং গবেষণায় সবচেয়ে পুরোনো ও ধারাবাহিক প্রতিষ্ঠানগুলির একটি। IBM ২০১৬ সালেই বিশ্বের প্রথম ক্লাউড-ভিত্তিক কোয়ান্টাম কম্পিউটিং পরিষেবা চালু করে (IBM Quantum Experience), যেখানে যে কেউ তাদের ছোট কোয়ান্টাম প্রসেসরে অনলাইনে কোড চালাতে পারত। হার্ডওয়্যারের দিক থেকে IBM নিয়মিত মাইলফলক ছুঁয়ে চলেছে: ২০১৭-১৮ সালে ~৫০-কিউবিটের প্রোটোটাইপ দেখানোর পর ২০২১ সালে তারা 127-কিউবিটের “Eagle” প্রসেসর উন্মোচন করে, যা ছিল প্রথম শতাধিক কিউবিটের চিপ। পরের বছর ২০২২-এ IBM তৈরী করে 433-কিউবিটের “Osprey” প্রসেসর, এবং তারা ঘোষণা দেয় ২০২3 সালে আসছে 1121-কিউবিটের “Condor” চিপ। তাদের রোডম্যাপে ২০২৫ সালের মধ্যে কয়েক হাজার কিউবিটের স্কেলেও যেতে চায়। IBM শুধু কিউবিট বাড়ানোই নয়, কিউবিটের গুণগত মান (ফিডেলিটি) উন্নয়ন এবং Quantum Volume নামক একটি পরিমাপক সূচক চালু করেছে যা একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সামগ্রিক ক্ষমতা প্রকাশ করে। IBM Q গবেষকরা ত্রুটি-সংশোধনের ক্ষেত্রেও সাফল্য পাচ্ছেন – ২০২3 সালে তারা প্রথমবার দেখিয়েছেন বেশি সংখ্যক কিউবিটের কোড ব্যবহার করে ত্রুটি হার কমানো সম্ভব, যা ত্রুটি-সংশোধিত লজিক্যাল কিউবিট তৈরির পথে একধাপ অগ্রগতি। IBM-এর কৌণিক হার্ডওয়্যার বলতে উল্লেখযোগ্য হল তাদের আলাদা IBM Quantum System One প্যাকেজড ডেটা সেন্টার, যা ইতিমধ্যে ক্লায়েন্টদের (যেমন জার্মানির Fraunhofer Society, জাপানের University of Tokyo) কাছে ইনস্টল করা হচ্ছে।
- Intel (ইন্টেল): প্রসিদ্ধ সেমিকন্ডাক্টর নির্মাতা Intel ভিন্নধর্মী কোয়ান্টাম হার্ডওয়্যারের উপর কাজ করছে। তারা একদিকে IBM/Google-এর মতো সুপারকন্ডাক্টিং কিউবিট চিপ বানিয়েছে – যেমন ২০১৮ সালে 49-কিউবিটের “Tangle Lake” টেস্ট চিপ তারা কুইটেক (নেদারল্যান্ডস) গবেষণা অংশীদারকে সরবরাহ করে। Intel এর মতে একটি কাজের উপযোগী বৃহৎ-স্কেলের কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জন্য সম্ভাব্য মিলিয়ন-এর বেশি কিউবিট প্রয়োজন হবে, তাই তারা শুরু থেকেই স্কেল-আপের চ্যালেঞ্জগুলো নজরে রাখছে। সুপারকন্ডাক্টিং কিউবিটের পাশাপাশি Intel সিলিকন-ভিত্তিক স্পিন কিউবিট (electron spin in quantum dots) নিয়েও গবেষণা করছে, কারণ স্পিন কিউবিট আকারে ক্ষুদ্রতর এবং প্রচলিত সেমিকন্ডাক্টর ফ্যাব্রিকেশনের মাধ্যমে তৈরি করা সহজ হতে পারে। Intel ইতিমধ্যেই ৩০০মিমি সিলিকন ওয়েফারে স্পিন কিউবিট তৈরির প্রযুক্তি উন্নয়ন করেছে এবং “Horse Ridge” নামে ক্রায়োজেনিক কন্ট্রোল চিপ বানিয়েছে যা অত্যন্ত নিম্ন তাপমাত্রায় থেকেই বহু কিউবিটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যদিও Intel-এর বর্তমান কিউবিটের সংখ্যাগত রেকর্ড IBM/Google-এর চেয়ে কম, তারা দীর্ঘমেয়াদে স্কেলেবল ও বাণিজ্যিকভাবে টেকসই কোয়ান্টাম আর্কিটেকচার তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে।
- Microsoft (মাইক্রোসফট): মাইক্রোসফট কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রসঙ্গে একটি ভিন্ন পন্থা নিয়েছে – তারা বেশ কয়েক বছর ধরে টপোলজিকাল কিউবিট নামক এক অভিনব ধারণার উপর গবেষণা করছে। সাধারণ সুপারকন্ডাক্টিং বা আইয়ন-ট্র্যাপ কিউবিটগুলোর তুলনায় টপোলজিকাল কিউবিট অনেক বেশি ত্রুটি-সহনশীল হতে পারে বলে ধারণা, কেননা এতে কিউবিটের তথ্য টপোলজিকালি সুরক্ষিত (প্রকৃতপক্ষে কণার কোয়ান্টাম অবস্থা “নট” বা চক্রাকারে বাঁধা থাকে) থাকে। মাইক্রোসফটের গবেষকেরা Majorana zero modes নামক কোয়াজিপার্টিকলের সাহায্যে এমন কিউবিট তৈরির চেষ্টা করছেন যা তাপীয় গোলমালেও তথ্য হারাবে না। দীর্ঘদিন পরীক্ষার পর ২০২৩ সালে মাইক্রোসফট ঘোষণা করে যে তারা সফলভাবে একটি টপোলজিকাল কিউবিট-এর সংকেত শনাক্ত করতে পেরেছে এবং এই ভিত্তিতে প্রথম প্রোটোটাইপ কোয়ান্টাম চিপ “Majorana 1” তৈরি করেছে। মাইক্রোসফটের দাবী, এই Majorana-ভিত্তিক টপোলজিকাল কিউবিট দিয়ে ভবিষ্যতে একটি একক চিপে মিলিয়ন কিউবিট স্কেল আপ করা সম্ভব হতে পারে। যদিও স্বাধীন গবেষকরা Microsoft-এর এ দাবির পরিপূর্ণ যাচাই চাইছেন এবং কিছুটা সন্দেহ পোষণও করেছেন, তবে এটি একটি চাঞ্চল্যকর অগ্রগতি। হার্ডওয়্যারের পাশাপাশি মাইক্রোসফট Q# নামে কোয়ান্টাম প্রোগ্রামিং ভাষা ও ডেভেলপমেন্ট কিট প্রকাশ করেছে এবং Azure Quantum নামে প্ল্যাটফর্ম চালু করেছে যেখানে বিভিন্ন কোয়ান্টাম হার্ডওয়্যারের (IonQ, Quantinuum ইত্যাদির) ক্লাউড এক্সেস সরবরাহ করা হচ্ছে।
উপরের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন অগ্রগতি থাকলেও সবার মিলিত লক্ষ্য হল একটি ব্যবহারযোগ্য, বড় স্কেলে কাজ করতে সক্ষম ও ত্রুটিমুক্ত কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করা। IBM ও Google যেখানে সারা বিশ্বের সামনে প্রকাশ্য প্রদর্শনের মাধ্যমে এগোচ্ছে, Intel একটু নেপথ্যে থেকে প্রযুক্তিগত ভিত্তি তৈরিতে ব্যস্ত এবং Microsoft পুরোপুরি বিপ্লবী একটি ধারণা সফল করে বাজিমাত করার চেষ্টায় আছে। এদের D-Wave, IonQ, Rigetti, Quantinuum-এর মতো স্টার্টআপ ও অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলিও নিজ নিজ পদ্ধতিতে কোয়ান্টাম হার্ডওয়্যার উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ব্যবহারক্ষেত্র
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সম্ভাব্য প্রয়োগক্ষেত্র অনেক। এখানে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করা হলো, যেখানে কোয়ান্টাম কম্পিউটার বিপ্লব ঘটাতে পারে:
- ক্রিপ্টোগ্রাফি: আধুনিক ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থার অনেকটাই নির্ভর করে বড় সংখ্যার মৌলিক উৎপাদকে বিশ্লেষণ (factoring) ও ডিজক্রিট লগারিদম সমস্যার জটিলতার ওপর (উদাহরণ: RSA ও ECC এনক্রিপশন)। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের শোরের অ্যালগরিদম এই সমস্যাগুলো কে সহজ করে দেয়, যা কার্যত প্রচলিত পাবলিক-কী এনক্রিপশন পদ্ধতিগুলোকে ভঙ্গযোগ্য করে তুলবে। এর অর্থ, একটি পূর্ণক্ষমতার কোয়ান্টাম কম্পিউটার এলে বর্তমান ব্যাংকিং, ই-комার্স, ডাটা এনক্রিপশন পদ্ধতিগুলো ঝুঁকির মুখে পড়বে – সেকেন্ডের মাঝেই কোড ভেঙে ফেলা সম্ভব হবে। এজন্যই এখন থেকেই Post-Quantum Cryptography অর্থাৎ কোয়ান্টাম-সহনশীল ক্রিপ্টোগ্রাফি অ্যালগরিদম উন্নয়ন চলেছে, যাতে কোয়ান্টাম যুগ আসার আগেই নিরাপদ বিকল্প পদ্ধতি প্রস্তুত থাকে। অন্যদিকে কোয়ান্টাম কম্পিউটার কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফি (যেমন Quantum Key Distribution, QKD) ও নিরাপদ যোগাযোগের নতুন পদ্ধতিও এনেছে, যেখানে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়ম অনুযায়ী কোন অননুমোদিত তৃতীয় পক্ষ তথ্য চুরি করতে গেলে ধরা পড়ে যাবে। ফলে কোয়ান্টাম কম্পিউটার একদিকে বিদ্যমান এনক্রিপশন ভাঙতে সক্ষম হবে, একই সাথে নতুন প্রজন্মের আল্ট্রা-সিকিওর যোগাযোগের দিগন্তও খুলে দেবে।
- ওষুধ আবিষ্কার ও জৈবপ্রযুক্তি: ঔষধ আবিষ্কার প্রক্রিয়ায় প্রধান চ্যালেঞ্জ হল জটিল জৈব-রাসায়নিক সিস্টেমকে সঠিকভাবে মডেল ও সিমুলেট করা। প্রোটিন ভাঁজ (protein folding), ওষুধ-লিগ্যান্ডের বন্ধন শক্তি গণনা, নিউণ বিক্রিয়া পথ বিশ্লেষণ – এসব কাজ ক্লাসিক্যাল সুপারকম্পিউটারেও প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় যখন সিস্টেমের আকার বড় হয়। কোয়ান্টাম কম্পিউটার তার কোয়ান্টাম প্রকৃতির দরুন সরাসরি 이러한 সিস্টেমের সিমুলেশন করতে পারে অনেক বেশি নিখুঁতভাবে। 1982 সালে ফেইনম্যান যে আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন তা এখানেই – “প্রকৃতিকে সিমুলেট করতে প্রকৃতিসদৃশ কম্পিউটার” ব্যবহার। বর্তমানে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো গবেষণা করছে কীভাবে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ব্যবহার করে নতুন ওষুধের প্রার্থী অণুগুলোর গুণাগুণ দ্রুত যাচাই করা যায়। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর অভূতপূর্ব ক্ষমতা আরও জটিল এবং বৃহৎ অণুর অন্তর্মূলগত কোয়ান্টাম প্রভাবগুলো হিসাব করতে সক্ষম, যা ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার দিয়ে করা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ওApproximate হয়। মিশ্র-কৌশলী (হাইব্রিড) কোয়ান্টাম-ক্লাসিক্যাল অ্যালগরিদম যেমন Variational Quantum Eigensolver (VQE) ব্যবহার করে প্রোটিন-লিগ্যান্ড ইন্টার্যাকশন বা প্রোটিনের সক্রিয় স্থানে জলের অণুর ভূমিকা ইত্যাদি হিসাব করা সম্ভব হচ্ছে, যা ওষুধের কার্যকারিতা নির্ধারণে সহায়ক। মাইক্রোসফটসহ অনেক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে বায়োমেডিক্যাল অংশীদারদের সাথে কাজ করছে কোয়ান্টাম সিমুলেশনের মাধ্যমে ড্রাগ ডিসকভারি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমে নতুন ওষুধ উদ্ভাবনের সময় ও ব্যয় উভয়ই অনেক কমে আসবে, কেননা যেসব কেমিক্যাল বিক্রিয়া বর্তমান প্রযুক্তিতে যথাযথ মডেল করা যায় না সেগুলোও কোয়ান্টাম সিমুলেশনের আওতায় আসবে।
- মেটেরিয়াল সায়েন্স ও রসায়ন: উপকরণ বিজ্ঞানেও কোয়ান্টাম কম্পিউটার যুগান্তকারী হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নবনবীন উপাদান (materials) যেমন নতুন সুপারকন্ডাক্টর, ব্যাটারি উপাদান, ক্যাটালিস্ট ইত্যাদি আবিষ্কারের জন্য তাদের পরমাণু-পর্যায়ের ধর্ম বুঝতে হয়, যা মূলত কোয়ান্টাম ভৌতবিজ্ঞানের সমস্যা। ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারে ইলেক্ট্রনগুলোর পারস্পরিক আনঙ্গিকতা (interaction) বা কোয়ান্টাম প্রভাবসহ পুরো সিস্টেম সঠিকভাবে সিমুলেট করা প্রায় অসম্ভব – অ্যাপ্রক্সিমেশনের আশ্রয় নিতে হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে ফল যথেষ্ট প্রত্যাশিত হয় না। কোয়ান্টাম কম্পিউটার এই ধরনের কোয়ান্টাম বহুদেহী (many-body) সমস্যার সঠিক সমাধানে বিশেষভাবে সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ, উচ্চ-তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাকটর পদার্থ কেন বৈদ্যুতিক প্রবাহকে বিনা-প্রতिरोधে পরিচালনা করতে পারে, তা পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা এখনো কঠিন; কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে সুপারকন্ডাক্টিং উপকরণের মডেল তৈরি করে ইলেক্ট্রনদের যৌথ কোয়ান্টাম অবস্থা বিশ্লেষণ করা সম্ভব, যা এই রহস্য উদঘাটনে সহায়তা করবে। আবার, জটিল অর্ধপরিবাহী পদার্থ বা কোয়ান্টাম ম্যাগনেটের (কোয়ান্টাম চুম্বক) ধর্মাবলীকেও কোয়ান্টাম কম্পিউটার নির্ভুলভাবে বের করতে পারবে, যেখানে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার এটিতে হিমশিম খায়। উপকরণ বিকাশে কোয়ান্টাম কম্পিউটার সরাসরি পরমাণু ও ইলেক্ট্রনের কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য সিমুলেট করে দেবার ফলে নতুন সংকর ধাতু, চুম্বকীয় উপাদান, জৈব উপকরণ ইত্যাদির ডিজাইন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা ভার্চুয়ালি করা যাবে খুব কম সময়ে। এর বাস্তব সুফল হবে আরও উন্নত ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, দক্ষতর সৌর প্যানেল, অধিক ধারণক্ষম ব্যাটারি, টেকসই ক্যাটালিস্ট এবং অন্যান্য উদ্ভাবনে । একটা উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক ব্যাটারি প্রযুক্তিতে নতুন ক্যাথোড বা অ্যানোড উপাদান খুঁজতে গবেষকরা নিরন্তর চেষ্টা করছেন; কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমে শত শত সম্ভাব্য যৌগের বৈশিষ্ট্য দ্রুত অনুসন্ধান করে সবচেয়ে উপযোগী কয়েকটি প্রার্থী বাছাই করা সম্ভব, যা গবেষণাকে অনেক বেশি লক্ষ্যভিত্তিক ও দ্রুত করবে।
উপরের ব্যবহারক্ষেত্রগুলি ছাড়াও ফাইন্যান্সে পোর্টফোলিও অপ্টিমাইজেশন, মেশিন লার্নিংয়ে কোয়ান্টাম মেশিন লার্নিং, লজিস্টিকসে কম্বিনেটরিয়াল অপ্টিমাইজেশন, এমনকি মহাকাশবিজ্ঞানে জটিল সিস্টেমের সিমুলেশন ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা চলছে। যদিও এখনই হাতে কলমে কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে এই সমস্যাগুলোর উৎকৃষ্ট সমাধান বের হয়নি (কারণ বর্তমান কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলো আকারে ছোট এবং NISQ পর্যায়ে আছে), তবুও নিকট ভবিষ্যতে এদের ক্ষমতা বাড়ার সাথে সাথে বাস্তব দুনিয়ায় প্রভাব পড়তে শুরু করবে।
বর্তমান চ্যালেঞ্জ: ত্রুটি সংশোধন, স্কেলিং সমস্যা, কোয়ান্টাম ডিকোহারেন্স
কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানো সহজ কাজ নয়। এর পথে কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যার সমাধান না হলে কোয়ান্টাম কম্পিউটার পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছবে না। প্রধান তিনটি চ্যালেঞ্জ হলো – (ক) ত্রুটি সংশোধন ও কোয়ান্টাম নির্ভুলতা, (খ) স্কেলিং বা বৃহৎ পরিসরে প্রসারণ, এবং (গ) কোয়ান্টাম ডিকোহারেন্স সমস্যা।
- ত্রুটি সংশোধন (Quantum Error Correction): আগেই আলোচনা হয়েছে যে কিউবিট অত্যন্ত সংবেদনশীল – সামান্য পরিবেশীয় প্রভাবেও এরা তাদের অবস্থা হারিয়ে ফেলে (decoherence) কিংবা গেট অপারেশন চলাকালে ভুল ফলাফল তৈরির ঝুঁকি থাকে। বর্তমান “NISQ” কোয়ান্টাম প্রসেসরগুলোর প্রতিটি অপারেশনে ভুল (error) হওয়ার সম্ভবনা থাকে, যা দূর করতে না পারলে বড় মাপের কোন কম্পিউটেশন চলবেই না। সমাধান হচ্ছে কোয়ান্টাম এরর কারেকশন নামের পদ্ধতিতে অনেকগুলো ভৌত (physical) কিউবিট মিলে একটি যৌথ ত্রুটিসহিষ্ণু লজিক্যাল কিউবিট গঠন করা। কিন্তু সমস্যা হলো, এই পদ্ধতিতে প্রচুর অতিরিক্ত কিউবিট লাগে। উদাহরণস্বরূপ, জনপ্রিয় সারফেস কোড পদ্ধতিতে একটি মাত্র লজিক্যাল কিউবিটের জন্য কয়েক শ’ থেকে হাজারখানেক ফিজিক্যাল কিউবিট পর্যন্ত দরকার হতে পারে, যদি প্রতিটি ভৌত কিউবিটের ত্রুটি হার ~১% থাকে। গবেষণা ইঙ্গিত করছে, বিশ্বস্তভাবে বড় শোরের অ্যালগরিদম চালাতে গেলে প্রতিটি লজিক্যাল কিউবিটের ত্রুটি হার $10^{-12}$ বা তার কম রাখতে হবে, যেটি অর্জন করতে প্রতিটি লজিক্যাল কিউবিট গঠনে হাজার হাজার ভৌত কিউবিট একসঙ্গে কাজ করাতে হতে পারে। এত বেশি কিউবিট একত্র করা বর্তমান প্রযুক্তিতে অসম্ভব ব্যাপার মনে হলেও সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে একবার যদি ভৌত কিউবিটের ত্রুটি হার একটি নির্দিষ্ট থ্রেশহোল্ডের নিচে নামানো যায় (~0.1% বা তার কম), তাহলে অনেক কম সংখ্যক কিউবিট দিয়েও কার্যকর এরর কারেকশন করা সম্ভব হবে। বর্তমানে Google, IBM সহ সকল প্রতিষ্ঠানের অগ্রাধিকার হল প্রতিটি গেট অপারেশন ও কিউবিটের ভুলের হার কমিয়ে সেই থ্রেশহোল্ডের নিচে আনা (ইতিমধ্যে ২-কিউবিট গেট ফিডেলিটি ৯৯.৯% অতিক্রম করেছে অনেক সিস্টেমে)। এর পাশাপাশি ছোট স্কেলের ত্রুটি সংশোধনের ডেমো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে – যেমন ১৭ কিউবিটের কোড (দূরত্ব-৩) থেকে 49 কিউবিট (দূরত্ব-৫) কোডে আপগ্রেড করে গুগল দেখিয়েছে যে ত্রুটি হার কিছুটা কমানো যায়। সারসংক্ষেপে, ত্রুটি সংশোধন কোয়ান্টাম কম্পিউটারের অপরিহার্য উপাদান, কিন্তু এটি সম্পূর্ণরূপে সক্ষম করতে আমাদের অনেক বেশি ও ভালো মানের কিউবিট দরকার।
- স্কেলিং সমস্যা (পরিসর বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ): একটি-দুটি কিউবিট নয়, কাজের কম্পিউটারের জন্য আমাদের হাজার, লক্ষ, কিংবা মিলিয়ন কিউবিট দরকার হবে (ত্রুটি সংশোধনের কারণে সংখ্যাটি আরও বাড়তে পারে)। বর্তমানে IBM সর্বোচ্চ ৪৩৩-কিউবিট হার্ডওয়্যার প্রদর্শন করেছে এবং ১০০০+ কিউবিটের চিপের দ্বারপ্রান্তে আমরা। কিন্তু এখান থেকে মিলিয়ন কিউবিটের স্কেলে যেতে গেলে প্রকৌশলীরা অভাবনীয় সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন। প্রথমত, এত বিপুল সংখ্যক কিউবিটকে সিগন্যাল দেওয়া ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ইলেকট্রনিক্স, ওয়্যারিং এবং রেফ্রিজারেশন ব্যবস্থাকে বর্তমানে যেভাবে করা হয় তার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ডিজাইন করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, এখন প্রতিটি কিউবিটের জন্য আলাদা মাইক্রোওয়েভ কন্ট্রোল লাইন লাগে; মিলিয়ন কিউবিট হলে মিলিয়ন তার নামিয়ে ক্রায়োস্ট্যাটে ঢোকানো অবাস্তব, সুতরাং মাল্টিপ্লেক্সিং ও অন-চিপ কন্ট্রোল ইলেকট্রনিক্স দরকার হবে। Intel এই কারণে ক্রায়ো-ইলেকট্রনিক কন্ট্রোল চিপ (Horse Ridge) বানাচ্ছে যাতে একাধিক কিউবিটকে একই লাইন দিয়ে চালানো যায়। দ্বিতীয়ত, এত কিউবিটের সিস্টেমে কিউবিট-টু-কিউবিট সংযোগ (connectivity) এবং কোয়ান্টাম গেট অপারেশন সংগঠিত রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হবে – বড় প্রসেসরে কিউবিট দূরে থাকলে তাদের মধ্যে সরাসরি গেট অপারেশন করা যায় না, এর জন্য কোয়ান্টাম স্বাপ (swap) গেটের শৃঙ্খল বা বিশেষ ব্যবস্থার দরকার হয়, যা আরও ত্রুটি সংযোজন করে। IBM এই সীমাবদ্ধতা মোকাবিলায় ৩ডি চিপ স্ট্যাকিং ও মডুলার আর্কিটেকচারের পরিকল্পনা করছে, যেখানে আলাদা প্রসেসর মডিউল সংযুক্ত করে কিউবিট সংখ্যা বাড়ানো যাবে। তৃতীয়ত, স্কেল বাড়ানোর সাথে সাথে উৎপাদনশীলতার (yield) বিষয় আসে – প্রতিটি কিউবিট যেন নির্দিষ্ট গুণমান বজায় রাখে এবং হাজার হাজার কিউবিটের মধ্যে অল্প কয়েকটি খারাপ কিউবিট পুরো সিস্টেমের কর্মক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে। তাই নির্মাণ প্রক্রিয়া, উপকরণ বিশুদ্ধতা, সার্কিট ডিজাইন ইত্যাদিতেও স্কেলিংয়ের সাথে সাথে পরিবর্তন আনতে হবে।
- কোয়ান্টাম ডিকোহারেন্স: এটি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের এক নম্বর শত্রু। ডিকোহারেন্স বলতে কোয়ান্টাম সিস্টেম যখন তার কোহেরেন্ট (একীভূত) কোয়ান্টাম অবস্থা হারিয়ে ফেলে এবং পরিবেশের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে যায়। প্রতিটি কিউবিটের একটি বৈশিষ্ট্য হলো তার কোহেরেন্স টাইম – কতক্ষণ পর্যন্ত এটি সুপারপজিশন বা এনট্যাংলড অবস্থা ধরে রাখতে পারে। সুপারকন্ডাক্টিং ট্রান্সমন কিউবিটের ক্ষেত্রে T1, T2 টাইম (রিল্যাক্সেশন ও ডিফেজিং টাইম) সাধারণত কয়েক দশ থেকে কয়েক শত মাইক্রোসেকেন্ড মাত্র (সর্বোৎকৃষ্ট গবেষণাগারে কিছু মিলিসেকেন্ড পর্যন্ত পৌঁছেছে। আইয়ন ট্র্যাপ কিউবিটের কোহেরেন্স টাইম সেকেন্ড পর্যায়েও হতে পারে, কিন্তু সেখানে গেট অপারেশন ধীর হয়। অর্থাৎ, যে সময়ের মধ্যে কম্পিউটেশন শেষ করা দরকার তার পরে কিউবিটগুলোর অবস্থা অর্থহীন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। ডিকোহারেন্স আসে চারপাশের তাপ, বিকিরণ, কম্পন, ইত্যাদি থেকে – তাই কোয়ান্টাম হার্ডওয়্যারকে ২০ মিলিকেলভিনের মতো চরম ঠাণ্ডায় রাখতে হয় এবং ইলেক্ট্রনিক্সকে বিশেষভাবে shield করা হয়। তবু সম্পূর্ণ মুক্তি মেলা ভার; উদাহরণস্বরূপ, সুপারকন্ডাক্টিং কিউবিটে আশপাশের উপাদানের পার্টিকল বিকিরণ বা কোসমিক রশ্মি আঘাত করলেও বিট-ফ্লিপ বা ফেজ-ফ্লিপ ত্রুটি ঘটতে পারে। স্কেল বৃদ্ধির সাথে এগুলো আরও বাড়বে। তাই গবেষকরা নতুন উপকরণ (যেমন উচ্চ-শুদ্ধতা সিলিকন, সুপারকন্ডাক্টর), ভাল shieldng, এবং qubit design উন্নত করছেন যাতে কোহেরেন্স টাইম বাড়ানো যায়। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ফ্লাক্সনিয়াম (Fluxonium) নামের এক ধরনের সুপারকন্ডাক্টিং কিউবিটে ১.৪ মিলিসেকেন্ডের কোহেরেন্স টাইম রেকর্ড করা হয়েছে – এই ধরণের উন্নতি ডিকোহারেন্স সমস্যা মোকাবিলায় সহায়ক হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, ডিকোহারেন্সকে পুরোপুরি হারানো যাবে না, তাই ত্রুটি সংশোধনের মাধ্যমেই এর প্রভাব কাটাতে হবে।
উপরের প্রতিটি চ্যালেঞ্জই জটিল, এবং এদের সমাধানে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং গবেষণা ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে। ভুল-সংশোধন, বড় স্কেলের ইঞ্জিনিয়ারিং ও কোহেরেন্স উন্নয়ন – এই তিন ফ্রন্টে পর্যাপ্ত অগ্রগতি হলে আমরা “ফল্ট-টলারেন্ট (ত্রুটি-সহনশীল) কোয়ান্টাম কম্পিউটার” পাবো, যা আমাদের কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে দক্ষতা নিয়ে যে কোনও কোয়ান্টাম অ্যালগরিদম চালাতে পারবে।
ভবিষ্যতের দৃষ্টিভঙ্গি: কোয়ান্টাম ইন্টারনেট, কোয়ান্টাম সিকিউরিটি, টপোলজিকাল কিউবিট
কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ভবিষ্যৎ খুবই উদ্দীপনাময় এবং কিছু দিগন্ত ইতিমধ্যেই আমাদের কল্পনায় স্পষ্ট হতে শুরু করেছে:
- কোয়ান্টাম ইন্টারনেট: এটি এমন এক ভবিষ্যৎ ইন্টারনেট যেখানে কম্পিউটার নেটওয়ার্কে কোয়ান্টাম বিট (কিউবিট) পাঠানো যাবে এবং কোয়ান্টামভাবে সংযুক্ত (entangled) রাখা যাবে। কোয়ান্টাম ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিপুল দূরত্বে অবস্থিত কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলিকে এনট্যাংলমেন্টের দ্বারা যুক্ত করে ডিস্ট্রিবিউটেড কোয়ান্টাম কম্পিউটিং করা সম্ভব হবে। যেমন একটি জটিল সমস্যার আংশিক কাজ বিভিন্ন স্থানের কোয়ান্টাম প্রসেসরে ভাগ করে সমান্তরালে করা এবং এনট্যাংলমেন্টের মাধ্যমে তাদের ফলাফল মিলিয়ে চূড়ান্ত উত্তর পাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া কোয়ান্টাম ইন্টারনেটের আরেকটি বড় প্রয়োগ সুরক্ষিত যোগাযোগ ব্যবস্থা – কোয়ান্টাম কী বিতরণ (QKD) এর মাধ্যমে শহর থেকে শহরে এনক্রিপশন চাবি বিনিময় ইতোমধ্যেই পরীক্ষামূলকভাবে হয়েছে (DARPA প্রথম ছোট কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক বানায় ২০০৩-২০০৭ সালে, এবং চীন ২০১৭ সালে উপগ্রহের মাধ্যমে বেইজিং-শাঙহাই কোয়ান্টাম লিংক স্থাপন করে)। কোয়ান্টাম ইন্টারনেট পুরোপুরি কার্যকর হতে এখনো বহু বছর বাকি, তবে এর ভিত্তি প্রযুক্তিগুলো – যেমন কোয়ান্টাম রিপিটার (যা দূর এনট্যাংলমেন্ট তৈরি করতে ব্যবহৃত হবে), অপটিকাল ফাইবার ও স্যাটেলাইটে কিউবিট স্থানান্তর ইত্যাদি – সক্রিয় গবেষণার বিষয়। ভবিষ্যতে একদিন আমরা হয়তো ক্লাসিক্যাল ইন্টারনেটের সমান্তরালে একটি কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক দেখতে পাবো যেখানে কোয়ান্টাম মেসেজিং ও কম্পিউটিং চলবে।
- কোয়ান্টাম সিকিউরিটি: ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম কম্পিউটার হাতে এলে বর্তমান নিরাপত্তা অবকাঠামোকে ঢেলে সাজতে হবে, আর সে কারণেই এখন থেকেই post-quantum ক্রিপ্টোগ্রাফি (PQC) আলগোরিদম প্রমিতকরণের কাজ চলছে। ২০২২-২৩ সালে NIST বেশ কিছু PQC অ্যালগরিদম নির্বাচিত করেছে যা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের হাত থেকে ডিজিটাল সিকিউরিটি রক্ষা করবে। এগুলো মূলত এমন গণিত সমস্যার উপর ভিত্তি করে বানানো যা কোয়ান্টাম কম্পিউটারও দ্রুত সমাধান করতে পারবে না (যেমন ল্যাটিস ভিত্তিক, কোড ভিত্তিক বা মাল্টিভ্যারিয়েট পলিনোমিয়াল সমস্যা)। একে একে RSA ও elliptic curve ক্রিপ্টোগ্রাফির জায়গা এসব PQC পদ্ধতি নেবে। অন্যদিকে, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি নিজেও নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখবে – Quantum Key Distribution ইতিমধ্যে ১০০+ কিলোমিটার দূরত্বে অপটিকাল ফাইবারে করা সম্ভব হচ্ছে এবং ব্যাংকিং ও সরকারি যোগাযোগে সীমিত আকারে এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতের “কোয়ান্টাম সিকিউর” যোগাযোগব্যবস্থা হয়তো ক্লাসিক্যাল ক্রিপ্টোগ্রাফির প্রয়োজনই অনেক ক্ষেত্রে কমিয়ে দেবে, কারণ মিস্ত্রী-চাবির মতো (one-time pad) কৌশলে QKD তে পাওয়া সম্পূর্ণ সুরক্ষিত কী দিয়ে এনক্রিপশন করা যাবে, যেটি ভাঙা কোয়ান্টাম দূরে থাক কোন কম্পিউটারেই অসম্ভব। অবশ্য, কোয়ান্টাম নিরাপত্তার প্রসঙ্গ আসলেই যুক্ত হয় National Security ও গোপনীয়তার বিষয় – কোয়ান্টাম কম্পিউটার যে সাইবার যুদ্ধ থেকে শুরু করে সমস্ত ডিজিটাল পরিকাঠামোকে প্রভাবিত করতে পারে, তা নজরে রেখে মহাশক্তিগুলো আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছে।
- টপোলজিকাল কিউবিট: বর্তমান কোয়ান্টাম হার্ডওয়্যারের সবচেয়ে বড় বাধা হলো ত্রুটি এবং ডিকোহারেন্স। টপোলজিকাল কিউবিট এই সমস্যার একটি মৌলিক সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করে – কিউবিটের তথ্য এমন কণায় ধারণ করা যাতে তার টপোলজিকাল বৈশিষ্ট্যের কারণে স্থানীয় পরিবেশীয় গোলমাল সহজে তাকে বিঘ্নিত করতে না পারে। এটি করতে গিয়ে টপোলজিকাল ম্যাটার ও কোয়াজি-কণার আশ্রয় নিতে হয় (যেমন Majorana fermion, Anyon ইত্যাদি)। মাইক্রোসফট এই পথে অগ্রগামী, এবং সম্প্রতি তারা “Majorana zero mode” সনাক্তের দাবীসহ প্রথম টপোলজিকাল কোয়ান্টাম প্রসেসর ইউনিট তৈরির ঘোষণা দিয়েছে। যদি টপোলজিকাল কিউবিট বাস্তবে কার্যকর হয়, তবে প্রতিটি কিউবিট স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অনেক স্থিতিশীল হবে এবং আলাদা করে ত্রুটি সংশোধনের বাড়তি ঝামেলা কমে আসবে। এর ফলে স্কেলিংও সহজ হবে – যেহেতু প্রত্যেক কিউবিট অনেক কম ত্রুটিপ্রবণ, তাই খুব বেশি অতিরিক্ত কিউবিট দরকার হবে না। এক কথায়, টপোলজিকাল কোয়ান্টাম কম্পিউটার হতে পারে একটি গেম-চেঞ্জার। অবশ্য এখনো এ প্রযুক্তি প্রাথমিক গবেষণা পর্যায়ে রয়েছে, এবং এমনও হতে পারে যে কাঙ্ক্ষিত Majorana কণা বাস্তবে মজবুতভাবে ব্যবহারের উপযোগী নাও হতে পারে (কিছু বিজ্ঞানী Microsoft-এর সাম্প্রতিক দাবিতে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, আরও পরীক্ষার প্রয়োজন বলছেন। তবুও, টপোলজিকাল কিউবিট যদি সফল হয়, তা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ভবিষ্যতের রূপরেখা এক লহমায় বদলে দিতে পারে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ভবিষ্যৎ এক কথায় আমাদের ক্লাসিক্যাল কম্পিউটিং ধারণাকে পরিপূরক হিসেবে সমৃদ্ধ করবে, প্রতিস্থাপন নয়। আশা করা হচ্ছে, আগামী দুই দশকের মধ্যে আমরা মাঝারি আকারের ত্রুটি-সংশোধিত কোয়ান্টাম কম্পিউটার হাতে পাবো যা বিশেষ কিছু কাজ দুর্দান্ত দ্রুত করতে পারবে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার এবং ক্লাসিক্যাল সুপারকম্পিউটার একসাথে হাইব্রিড মডেলে কাজ করবে – যেখানে যা যার জন্য উপযুক্ত সেটি সেই প্ল্যাটফর্মে চলবে। যেমন ক্রিপ্টোগ্রাফিক কী কম্পিউটেশন বা অণু সিমুলেশন যাবে কোয়ান্টামে, আর সাধারণ ডাটাবেস ম্যানেজমেন্ট বা ওয়েব সার্ভিস চলবে ক্লাসিক্যালে। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের অগ্রগতির সাথে সাথে কোয়ান্টাম ইন্টারনেট এসে বর্তমান ইন্টারনেটের নিরাপত্তা ও ক্ষমতা বাড়াবে, কোয়ান্টাম সেন্সর এবং কোয়ান্টাম মেট্রোলজি নতুন মাত্রা পাবে (যেমন অত্যন্ত সংবেদনশীল ক্লক ও গ্রাভিটি সেন্সর)। সবমিলিয়ে, আমরা এক “কোয়ান্টাম-সক্ষম” বিশ্বে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, যেখানে কোয়ান্টাম যন্ত্রণা শুধুই গবেষণাগারের কৌতূহল নয় বরং দৈনন্দিন প্রযুক্তির অংশ হয়ে উঠবে।
শেষ কথা: কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর যাত্রা শুরু হয়েছে কয়েক দশক আগে ছোট্ট তাত্ত্বিক বীজ হিসেবে, যা আজ তরুণ বৃক্ষে পরিণত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে মহীরুহ হয়ে ছায়া বিস্তার করবে। এর ইতিহাস আমাদের শেখায় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনগুলি সময় নিয়ে হলেও আসবেই – 1940-এর দশকের সুবিশাল ভ্যাকুয়াম টিউব কম্পিউটার থেকে যেমন ধীরে ধীরে মোবাইল ফোনের প্রসেসর এসেছে, তেমনি কোয়ান্টাম কম্পিউটারও একদিন নিজের পথ খুঁজে নিবে। ভবিষ্যতের দুনিয়ায় কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, এবং প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞদের এখনই এই পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত হওয়া উচিত – কারণ এই পরিবর্তন শুধু কম্পিউটেশনের নয়, সমগ্র প্রযুক্তিগত পরিমণ্ডলের ধারা বদলে দেবে।