গাজা ভূখণ্ডের আজকের চিত্র ভয়াবহ: ক্ষুধার্ত শিশুদের কান্না শোনা যাচ্ছে, ধ্বংসস্তূপের মাঝে ঠান্ডায় কাঁপছে বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো, এবং তাদের এই দুর্দশা দেখা সত্ত্বেও বিশ্বের প্রভাবশালী শক্তিগুলো কার্যত নীরব। ইসরায়েল গাজায় সব ধরনের মানবিক সাহায্য প্রবেশ প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে, যার ফলে ২৩ লক্ষেরও বেশি মানুষ এক অভূতপূর্ব মানবিক সংকটে নিমজ্জিত। বোমাবর্ষণ ও যুদ্ধের তাণ্ডবের পর বেঁচে থাকা গাজার সাধারণ জনগণ এখন অবরোধজনিত চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে – খাদ্য, পানি, ঔষধ থেকে শুরু করে আশ্রয় পর্যন্ত সবকিছুর সংকট। এই ব্লগে আমরা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে গাজায় চলমান এই অবরোধের প্রভাব বিশ্লেষণ করবো, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রসঙ্গ উঠিয়ে দেখবো, জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থার প্রতিক্রিয়া মূল্যায়ন করবো, কেন বিশ্ব সম্প্রদায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে তা খতিয়ে দেখবো, এবং পশ্চিমা শক্তিগুলোর নীরবতা ও দ্বৈত নীতির সমালোচনা করবো। সর্বশেষে, এই সংকটের সম্ভাব্য সমাধানের কিছু দিক নিয়েও আলোচনা করা হবে।

গাজার সাধারণ মানুষের ওপর অবরোধের মানবিক সংকট

গাজায় চলমান অবরোধ সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে সেখানে বসবাসরত সাধারণ ফিলিস্তিনিদের ওপর। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য এবং সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে তাঁদের জীবন আজ বিপন্ন। যুদ্ধ এবং অবরোধ মিলিয়ে গাজায় মানবিক পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এটি সম্পূর্ণরূপে মানবসৃষ্ট একটি বিপর্যয় বলে অভিহিত হচ্ছে। গত অক্টোবরে সংঘাত শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় ৪৫,০০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এবং প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষ যুদ্ধের কারণে ঘরবাড়ি ছেড়ে বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হয়েছেন। আশ্রয়হীন এই পরিবারগুলো বাধ্য হয়ে ক্যাম্প বা অস্থায়ী তাঁবুতে দিন কাটাচ্ছে, যেখানে ঠান্ডা, বাতাস ও বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার তেমন ব্যবস্থা নেই। শীতের তীব্র ঠান্ডায় পর্যাপ্ত পোশাক বা গরম থাকার ঠাঁই না পেয়ে সপ্তাহখানেকের মধ্যে কমপক্ষে সাতটি নবজাতক শিশু হাইপোথারমিয়ায় মারা গেছে। এক মায়ের করুণ বর্ণনায়, “আমরা বোমায় মরিনি, কিন্তু অবরোধের কারণে ঠান্ডায় আমার শিশু সন্তানটি মারা গেল”, এই বক্তব্য গাজার মানুষের অসহায় অবস্থার নির্মম চিত্র ফুটিয়ে তোলে।

অবরোধের ফলে গাজার অর্থনীতি এবং অবকাঠামো সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। সাম্প্রতিক যুদ্ধ এবং অবরোধে গাজার ৯০% বাড়িঘর ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ফলে প্রায় ১৮ লক্ষ মানুষ জরুরি আশ্রয়ের প্রয়োজনীয়তায় পড়েছে । হাসপাতালগুলোর অবস্থাও ভয়াবহ – গাজার ৯৫% হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্র কোনো না কোনোভাবে ক্ষতির শিকার হওয়ায় চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রায় অচল। রাস্তাঘাটের ৬৫% ধ্বংস হয়ে গেছে, যা ত্রাণ পৌঁছানো এবং রোগী পরিবহনে মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করছে। এসব কারণে গাজার অর্থনীতি ৮৩% পর্যন্ত সংকুচিত হয়ে পড়েছে । গাজাবাসীর সম্পূর্ণ জনসংখ্যাই এখন জীবিত থাকার জন্য বাইরের খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ইসরায়েলি অবরোধ ও হামলার দরুন এই খাদ্য সহায়তাও বারবার বন্ধ হয়ে গাজাকে দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে।

খাদ্য, পানি ও জ্বালানির ঘাটতি গাজার মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। অবরোধের আগে থেকেই গাজার ৮০% মানুষের জীবনযাত্রা বহুলাংশে আন্তর্জাতিক ত্রাণের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু বর্তমানে ইসরায়েল পূর্ণ অবরোধ আরোপ করায় ত্রাণের সেই শেষ অবলম্বনটুকুও বন্ধ। এমনকি সাময়িক যুদ্ধবিরতির সময়েও যে সামান্য খাদ্যসামগ্রী প্রবেশের সুযোগ মিলেছিল, অবরোধ পুনরায় কঠোর হওয়ার পর বাজারে আবারও খাবারের তীব্র অভাব দেখা দিয়েছে এবং মূল্য আকাশচুম্বী হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী (WFP) সতর্ক করেছে যে বর্তমানে গাজায় তাদের হাতে এমন পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী আছে যা দিয়ে সর্বসাধারণের জন্য গণরান্নাঘর ও বেকারিগুলো মাত্র দুই সপ্তাহ চালু রাখা যাবে; এর পরে যদি নতুন করে ত্রাণ ঢুকতে না পারে তবে খাবারও ফুরিয়ে যাবে। জ্বালানি প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা থাকায় পানি পরিশোধন ও সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম – Gaza’র পানি সরবরাহ কর্তৃপক্ষ সতর্ক করেছে যে বিদ্যমান জ্বালানি মজুদ মাত্র এক সপ্তাহ চলতে পারবে, তারপর বেশিরভাগ নলকূপ ও একমাত্র সক্রিয় ডাসালিনেশন প্ল্যান্টও বন্ধ হয়ে যাবে। চিকিৎসা খাতে অবস্থার আরও অবনতি ঘটছে; অনেক হাসপাতাল বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অভাবে পুরোপুরি কাজ করতে পারছে না এবং জরুরি ওষুধপত্রের মজুদ ফুরিয়ে এসেছে। গাজার প্রধান হাসপাতাল আল-শিফার পরিচালক জানান, উত্তর গাজা অঞ্চলে এখন পুরো এলাকার জন্য মাত্র তিনটি আইসিইউ বেড চালু আছে এবং একটি অক্সিজেন স্টেশন কাজ করছে – যখন যুদ্ধবিরতির পরে লক্ষাধিক মানুষ ওই এলাকায় ফিরেছে। তিনি হাহাকার করে বলেছেন, “সীমান্ত বন্ধ রাখাটা গাজার স্বাস্থ্য খাতের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনছে। এটি ঠিক উল্টো পদক্ষেপ যা আমাদের দরকার। আমাদের এখনই বিপর্যস্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে জাগিয়ে তোলার জন্য সহায়তা দরকার”

অবরোধের এই বাস্তবতায় গাজায় মানবিক কাজ করা সংস্থাগুলোকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রশাসনিক কাঠামো বিধ্বস্ত হয়ে পড়ায় এখন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোকে তাদের নিয়মিত কাজের বাইরে গিয়ে টিকে থাকার মৌলিক চাহিদা পূরণের দায়িত্বও নিতে হচ্ছে। এমইসিএ (মিডল ইস্ট চিলড্রেনস অ্যালায়েন্স) এর গাজা অফিসের প্রধান ওফা আল-দিরাওয়ি বলেন, “যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নেই বললেই চলে। ফলে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোকে এমন সব কাজ করতে হচ্ছে যা কখনো তাদের করার কথা ছিল না – ধ্বংসস্তুপ সরানো থেকে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং ময়লা অপসারণ পর্যন্ত সবকিছু” । একটি কার্যকর সরকার বা পৌর কর্তৃপক্ষ ছাড়া গাজায় এখন সম্পূর্ণ নৈরাজ্য এবং মানবিক সহায়তা কার্যক্রমেও নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে । ইসরায়েলি হামলায় আদালত, থানাসহ প্রশাসনিক কাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যার ফলস্বরূপ আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে এবং ত্রাণসামগ্রী লুট হওয়ার আশঙ্কা বেড়েছে।

এই সবকিছু মিলিয়ে গাজার সাধারণ মানুষ আজ জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে অবতীর্ণ। এক গাজাবাসী এই যুদ্ধবিরতির সময় সামান্য ত্রাণ পাওয়ার অভিজ্ঞতাকে এক কথায় “মিথ্যে আশা” বলে বর্ণনা করেছেন। অর্থনীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাহের আল-তাব্বা আক্ষেপ করে বলেন, “যুদ্ধবিরতিতে কিছু ট্রাক ঢুকেছিল বটে, কিন্তু যা ঢুকেছে তা আমাদের মৌলিক চাহিদার সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। কোনো নির্মাণসামগ্রী, কৃষি সরঞ্জাম বা সেবা খাতের উপকরণ আসেনি – কেবল কিছু খাদ্যসামগ্রী। প্রতিদিন আমরা সবচেয়ে মৌলিক জিনিসগুলো খুঁজে ফিরি, আর খালি হাতে ফিরে আসি” । বাস্তবে গাজার পুরো জনগোষ্ঠীকে এক প্রকার অনাহারে রেখেই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যা আধুনিক ইতিহাসে নজিরবিহীন এক মানবিক বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিতে পারে।

আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দৃষ্টিকোণ

গাজার ওপর এই অবরোধ কেবল মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের দৃষ্টিতেও গুরুতরভাবে বেআইনি এবং অনৈতিক। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুসারে কোনো সংঘাতেই নির্বিচারে সাধারণ নাগরিকদের শাস্তি দেওয়া বা তাদের জীবনযাত্রার জন্য অপরিহার্য উপকরণ থেকে বঞ্চিত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু গাজায় যা ঘটছে তা স্পষ্টতই “সমষ্টিগত শাস্তি” (collective punishment) হিসেবে পরিগণিত – সমগ্র জনগণকে অবরোধের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, যা জেনেভা কনভেনশনের চরম লঙ্ঘন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভাষ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলের এই পূর্ণ অবরোধ “আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন” ও মানবাধিকারের চূড়ান্ত অবমাননা । তারা উল্লেখ করেছে, গাজার সাধারণ জনগণের প্রতি এই ধরনের সমষ্টিগত শাস্তিমূলক অবরোধ যুদ্ধাপরাধের শামিল এবং নির্মম ও অবৈধ

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো স্পষ্টভাবে বলছে যে গাজায় খাবার, পানি, ওষুধের প্রবেশ আটকে রাখা এবং জনগণকে অনাহার-অপুষ্টির মধ্যে রাখার এই নীতিটি যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (crime against humanity) হিসেবে গণ্য হতে পারে । আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) ইতোমধ্যে বিষয়টি তদন্তের অধীনে নিয়েছে; এমনকি ২০২৪ সালে আইসিসি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে “ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার” এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে পরোয়ানাও জারি করেছিল। এই অভিযোগগুলোর মূল কথা হল: জনগণকে ইচ্ছাকৃতভাবে খাদ্য-ওষুধ থেকে বঞ্চিত রেখে অসহায় করা, যা একটি যুদ্ধের পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ধরনের কার্যকলাপ চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের ৫৫ ও ৫৯ নম্বর অনুচ্ছেদের সরাসরি লঙ্ঘন, যেখানে দখলদার শক্তিকে স্পষ্টভাবে অধীনস্থ জনগণের খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহ নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা দেয়া আছে ।

অবরোধ জারি রেখে ক্ষুধা ও অভাবকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার নজির ইতিহাসে খুবই অল্প; এটি মানবতাবিরোধী আচরণের চূড়ান্ত রূপগুলোর একটি। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) সম্প্রতি স্পষ্ট ভাষায় বলেছে যে ইসরায়েল ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় “ক্ষুধাকে যুদ্ধের একটি পদ্ধতি হিসেবে” প্রয়োগ করছে, যা আন্তর্জাতিক মানবিক আইনে মারাত্মক যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী অবরোধের ফলে ইতোমধ্যে হাজারো ফিলিস্তিনি অপুষ্টি, পানীয় জলের অভাব ও রোগব্যাধিতে মারা গেছেন এবং আরও অনেকে একই কারণে প্রাণ হারানোর ঝুঁকিতে আছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ডও জোর দিয়ে বলেছেন, “গাজার জনগণের উপর এই অবরোধ মূলত একটি নিষ্ঠুর ও অবৈধ শাস্তি। একটি দখলদার শক্তি হিসেবে ইসরায়েলের স্পষ্ট আইনি দায়িত্ব আছে যে তারা গাজার জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করবে। অথচ সেই দায়িত্ব পালনের বদলে ইসরায়েল উল্টো সাহায্য আটকে দিয়ে সেই জনগণকে শাস্তি দিচ্ছে” । সংস্থাটি আরও বলছে, ১৬ বছরের অবরোধ গাজাকে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে এবং অক্টোবর ২০২৩ এর পর থেকে এই অবরোধ এতটাই তীব্র হয়েছে যে তা সরাসরি জনগণকে “engineered famine” বা পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে

আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে গাজা সংকট নিয়ে এক অন্তর্বর্তী আদেশে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে যে ইসরায়েলকে অবিলম্বে মানবিক সহায়তা প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে। দখলদার শক্তি হিসেবে এটি ইসরায়েলের আইনি বাধ্যবাধকতা যে তারা গাজার অসামরিক জনগণের জীবনধারণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। এই আদেশকে উপেক্ষা করে ইসরায়েল যেভাবে আবার সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপ করেছে, তা আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থার প্রতি চরম বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের সমতুল্য। আইনের শাসনের দিক থেকে দেখলে, গাজায় এই অবরোধ এবং মানবিক সাহায্য বন্ধ রাখা আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক নীতি, যেমন মানবিক আচরণ, সশস্ত্র সংঘাতে অসামরিকদের সুরক্ষা এবং “প্রয়োজনের ন্যূনতম স্তর” নিশ্চিত করার ধারণার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।

সংক্ষেপে, গাজায় মানবিক সাহায্য আটকানো শুধু নৈতিকভাবেই ন্যক্কারজনক নয়, বরং আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতেও তা গুরুতর অপরাধমূলক কাজ। এটি যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ উভয়ের সংজ্ঞায় পড়তে পারে, এবং এর জন্য আন্তর্জাতিক পরিসরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দাবি দিন দিন জোরালো হচ্ছে।

জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিক্রিয়া

গাজার ক্রমবর্ধমান মানবিক বিপর্যয়ে জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করলেও কার্যকর সমাধান এখনও অধরা। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বহুবার সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে “গাজা ধীরে ধীরে শিশুদের জন্য কবরস্থানে পরিণত হচ্ছে”, প্রতি দিন অসংখ্য শিশু নিহত বা আহত হওয়ার পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি সেখানে অবিলম্বে মানবিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন । জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ গত অক্টোবরে একটি প্রস্তাব বিপুল ভোটে গৃহীত করে গাজায় অবিলম্বে, টেকসই এবং পূর্ণমাত্রার মানবিক যুদ্ধবিরতি দাবি করে এবং একই সাথে গাজার সকল নাগরিকের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে অত্যাবশ্যকীয় ত্রাণসামগ্রী প্রবেশের সুযোগ দিতে বলেছে । ওই প্রস্তাবটি ১২০টি দেশের সমর্থনে পাস হয়, যেখানে মাত্র ১৪টি দেশ এর বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল । এর মাধ্যমে বিশ্ব জনমত স্পষ্ট হয়েছে যে, মানবিক ত্রাণ পৌঁছানো ঠেকানো কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং এটি বন্ধ হওয়া উচিত। সাধারণ পরিষদ আরও জোর দিয়ে বলেছে যে গাজার পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবিক নীতিমালা অনুযায়ী দেখভাল করতে হবে এবং সব পক্ষকে আইনি বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হবে।

জাতিসংঘের বিভিন্ন বিশেষায়িত সংস্থা – UNRWA, UNICEF, WHO ইত্যাদি – গাজায় সহায়তা দিতে গিয়ে এক নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। UNRWA (জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা) একাধিকবার সতর্ক করেছে যে তাদের জ্বালানি ও সরবরাহ ফুরিয়ে আসার কারণে গাজায় পরিষেবা প্রদান বন্ধ হওয়ার দশা হয়েছিল। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে জ্বালানি স্বল্পতার কারণে UNRWA তাদের কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছিল, যা দেখায় অবরোধ কতটা গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। UNICEF এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার বিবৃতি দিয়ে গাজার শিশু ও রোগীদের করুণ অবস্থার কথা বলেছে এবং চিকিৎসা ও পানি সরবরাহে বাধা দূর করার আহ্বান জানিয়েছে। এদিকে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী (WFP) গাজায় খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে “মহা বিপর্যয়” শব্দটি ব্যবহার করে বলেছে যে চলমান অবরোধ অব্যাহত থাকলে ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে আরও বহু মানুষের মৃত্যু ঘটবে

আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি (ICRC) ও চিকিৎসাবিষয়ক মানবিক সংগঠন ডক্টরস উইথআউট বর্ডার্স (MSF) প্রকাশ্যে গাজার পরিস্থিতিকে “অসম্ভব পরিস্থিতিতে মানবিক কাজ চালানোর চেষ্টা” হিসেবে বর্ণনা করেছে। MSF স্পেনের সভাপতি পলা গিল গাজাকে সরাসরি “একটি মৃত্যুকূপ” (death trap) বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন, “গাজায় মানবিকতা ধ্বংস করা হচ্ছে, আর আমরা তা নীরবে দেখতে পারি না” । তিনি বর্ণনা করেছেন, পরিবারগুলো কাঠ, প্লাস্টিক আর ছেঁড়া গদি দিয়ে বানানো অস্থায়ী ঝুপড়িতে কোনোমতে বেঁচে আছে; এখন সেখানে শীত ও ঝড়-বৃষ্টিও শুরু হয়েছে – “এই অবস্থায় ওরা কতদিন টিকে থাকবে?” । মেডিসিন স্যান্স ফ্রঁতিয়ার ও রেড ক্রস বারবার যুদ্ধরত পক্ষগুলোর প্রতি মানবিক বিরতির আহ্বান জানিয়েছে যাতে আহতদের চিকিৎসা ও নাগরিকদের নিরাপদে ত্রাণ গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়।

এছাড়াও, মানবাধিকার সংস্থা ও নাগরিক সমাজ সংগঠনগুলো বৈশ্বিক পর্যায়ে সরব হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো এক যৌথ বিবৃতিতে ইসরায়েলের এই অবরোধকে মানবাধিকার লঙ্ঘন আখ্যা দিয়ে অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সরাসরি আহ্বান জানিয়েছে যে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রকে ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে যাতে সে তার অবৈধ অবরোধ তুলে নেয়, পানি-বিদ্যুৎ সরবরাহ ফিরিয়ে দেয় এবং জরুরি খাদ্য, পানি, চিকিৎসা ও জ্বালানি ঢুকতে দেয়

আন্তর্জাতিক বিচার অঙ্গনেও কিছু পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে। যেমন ήδη আলোচনা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) গাজায় সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনা তদন্ত করছে। যদিও এই তদন্ত প্রক্রিয়া ধীরগতির এবং সংঘাত থামানোর জন্য তাৎক্ষণিক কোনও ফল দিতে পারছে না, তবুও এটা গুরুত্বপূর্ণ যে আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে প্রমাণ সংগ্রহ ও জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ এবং স্বাধীন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরাও গাজায় সংঘটিত ঘটনাবলী তদন্তের প্রস্তাব দিয়েছেন।

তবে আফসোসের বিষয়, জাতিসংঘ কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এই সমস্ত আহ্বান ও নিন্দা সত্ত্বেও স্থল পরিস্থিতিতে খুব একটা পরিবর্তন আসছে না। ইসরায়েল এসব সমালোচনা উপেক্ষা করে অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে, এবং তাদের মদদদাতা শক্তিগুলোও জাতিসংঘের আহ্বানে কান দিচ্ছে না। নিচের অংশে আমরা দেখব কেন বিশ্ব সম্প্রদায় আরও শক্ত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা: কার্যকর পদক্ষেপের অভাব কেন?

গাজার এই বিপর্যয়ে বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদমুখর হলেও রাষ্ট্রপর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ প্রায় অনুপস্থিত। বহু দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংগঠন নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিচ্ছে, কিন্তু ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনও কার্যকর চাপে রূপ নিতে পারছে না এসব প্রতিক্রিয়া। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ ও ভূরাজনৈতিক হিসাব কাজ করছে।

প্রথমত, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে জটিলতা: নিরাপত্তা পরিষদ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বারবার ব্যর্থ হয়েছে, মূলত কয়েকটি স্থায়ী সদস্য দেশের ভেটোর কারণে। উদাহরণসরূপ, ২০২৩ সালের শেষভাগে নিরাপত্তা পরিষদে যখন গাজায় মানবিক যুদ্ধবিরতি ও ত্রাণ প্রবেশের দাবি জানিয়ে প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, তখন পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে ১৪টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে প্রস্তাবটি আটকে দেয় । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে তারা এমন কোনও পদক্ষেপ সমর্থন করবে না যা ইসরায়েলের অনুমতি ছাড়া যুদ্ধবিরতি দাবি করে। ফলে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ফোরাম হয়েও নিরাপত্তা পরিষদ গাজায় তাত্ক্ষণিক মানবিক বিরতি কিংবা অবরোধ প্রত্যাহারের দাবিতে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। এই অচলাবস্থা ইসরায়েলকে কার্যত আরও উদ্ধত করে তুলেছে এবং তাদেরকে অপরাধ চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছে বলে অনেকেই মনে করেন।

দ্বিতীয়ত, বিশ্বশক্তির রাজনৈতিক স্বার্থ ও মিত্রতা: বহু পশ্চিমা দেশ ইসরায়েলকে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে দেখে এবং মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষার অংশ হিসেবে ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র তো সরাসরি ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় সামরিক এবং কূটনৈতিক পৃষ্ঠপোষক। অক্টোবরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই লক্ষ করা গেছে, মার্কিন সরকার গাজার ব্যাপারে কোনও কঠোর অবস্থান নেওয়া থেকে বিরত রয়েছে, বরং ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ জারি রেখেছে। যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই মার্কিন সরকার প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের নতুন অস্ত্র ইসরায়েলকে সরবরাহের অনুমোদন দিয়েছে, এমনকি যখন একই সময়ে গাজায় ব্যাপক অসামরিক প্রাণহানি ঘটেছে। এই ধরণের পদক্ষেপ ইসরায়েলকে একপ্রকার সবুজ সংকেত দেয় যে বড় মিত্ররা তাদের পাশেই আছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডাসহ অনেক পশ্চিমা দেশই ইসরায়েলের “আত্মরক্ষার অধিকার”-এর কথা জোরালোভাবে বলে আসছে, কিন্তু গাজার নিধনযজ্ঞ বন্ধে দৃশ্যমান কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

তৃতীয়ত, কূটনৈতিক দ্বিচারিতা ও জবাবদিহিতার অভাব: বৈশ্বিক রাজনীতিতে বড় শক্তিগুলোর দ্বৈত নীতি এই সংকটে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। একই ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় এক ক্ষেত্রে তারা কঠোর ব্যবস্থা নেয়, আর অন্য ক্ষেত্রে নীরব থাকে যদি অপরাধীর সঙ্গে তাদের মিত্রতা থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অন্য কোন দেশ যদি এরকম অবরোধ বসিয়ে অসংখ্য মানুষকে অনাহারে রেখে মারত, তাহলে হয়তো আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও বিচ্ছিন্নকরণের মুখে পড়ত। কিন্তু ইসরায়েলের ক্ষেত্রে তেমনটি হচ্ছে না, বরং অনেক সরকার নিন্দার ভাষাও নরম করে বলছে। এই দ্বিচারিতা এবং জবাবদিহিতা না থাকায় ইসরায়েল নিজের কার্যক্রমকে প্রায় বাধাহীনভাবে চালিয়ে যেতে পারছে।

চতুর্থত, আন্তর্জাতিক আইনের কার্যকর প্রয়োগের ঘাটতি: যদিও আন্তর্জাতিক আদালত ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরায়েলের পদক্ষেপকে বেআইনি বলেছে, বাস্তবে সেই আইন বলবৎ করার মত ক্ষমতা তাদের নেই যখন শক্তিশালী দেশগুলো সমর্থন না দেয়। আইসিসি বা আইসিজের কোন রায় বা পরোয়ানা কার্যকর করতে হলে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতা জরুরি। এখনও পর্যন্ত পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়াকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেনি। বরং যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আইসিসির যেকোনো পদক্ষেপের বিরোধিতা করে এসেছে। ফলে আইনি বিচারের হুমকিটুকুও ইসরায়েলের উপর কোনো তাৎক্ষণিক চাপ সৃষ্টি করতে পারছে না

সব মিলিয়ে, বিশ্ব সম্প্রদায়ের এই নিষ্ক্রিয়তা এবং অক্রিয় পদক্ষেপ ইসরায়েলকে পরোক্ষভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছে – যাকে অনেকেই “বিশ্বের নীরব সম্মতি” বলে অভিহিত করছেন। মানবাধিকারকর্মী ও চিকিৎসকেরা উদ্বেগের সাথে বলছেন, “Gazায় প্রতিদিন যে বীভৎসতা চলছে, বিশ্ব সেটাতে বধির ও অন্ধ হয়ে রয়েছে” । এই নীরবতা এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে অনীহার ফলে পরিস্থিতি ক্রমে আরও গুরুতর রূপ নিচ্ছে এবং একটি জেনোসাইডের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না বলে অনেকে সতর্ক করেছেন।

পশ্চিমা শক্তির নীরবতা ও দ্বৈত নীতি

গাজায় চলমান মানবিক বিপর্যয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকা ও প্রতিক্রিয়া বিশেষভাবে নজরে পড়ার মতো, কেননা এ ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান অনেকাংশেই নীরবতা, পক্ষপাত এবং দ্বৈত নীতির পরিচায়ক। একদিকে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো নিজেদেরকে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিশ্বব্যাপী রক্ষক হিসেবে দাবি করে, অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে সেই একই নীতির প্রয়োগে তারা আশ্চর্যজনকভাবে নীরব বা নির্লিপ্ত।

সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসাবে ইউক্রেন সংকট ও গাজা সংকটের প্রতি পশ্চিমা প্রতিক্রিয়ার পার্থক্যটা স্পষ্ট। ইউক্রেনে বেসামরিক মানুষের ওপর হামলার অভিযোগ এলে পশ্চিমা দেশগুলো তাৎক্ষণিকভাবে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানায়, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মাধ্যমে বিচার চায়। কিন্তু গাজার বেলায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডে একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। বরং অনেক পশ্চিমা নেতা ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা না করে প্রথমেই ইসরায়েলের নিরাপত্তার অধিকার নিয়ে কথা বলেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্ব গাজার বেসামরিক হতাহতের সংখ্যাকে অবিশ্বাস প্রকাশের চোখে দেখেছে; এমনকি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক পর্যায়ে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত নিহতের পরিসংখ্যান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। আবার ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশগুলো প্রকাশ্যে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল এবং ইসরায়েলের পক্ষে মত প্রকাশ করেছে যে “হামাসকে পরাস্ত না করা পর্যন্ত যুদ্ধ থামানো যাবে না”। এসব দেশের সরকার প্রধানরা শুরুতেই ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকে জোর দিয়ে উল্লেখ করেন, যদিও সেই আত্মরক্ষার নামে হাজার হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটছে – যা এক বড় ধরনের নৈতিক বৈপরীত্য

পশ্চিমা গণমাধ্যমের ভূমিকাতেও এই নীরবতা ও পক্ষপাত লক্ষ্যণীয়। বেশিরভাগ মূলধারার পশ্চিমা গণমাধ্যম গাজার পরিস্থিতি প্রচারে শুরুতে অনীহা দেখিয়েছে বা একপেশে বর্ণনা দিয়েছে বলে সমালোচনা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু পশ্চিমা মিডিয়ায় গাজার নিহত অসংখ্য বেসামরিকদের চেয়ে ইসরায়েলের নিরাপত্তা বিবৃতিকেই বেশি প্রাধান্য দিতে দেখা গেছে। অক্টোবরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর লন্ডন, নিউইয়র্ক, প্যারিসে যখন হাজার হাজার মানুষ গাজায় হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এল, তখনও অনেক পশ্চিমা সরকারের অবস্থান অপরিবর্তিত থেকেছে

এমন নীরবতা ও দ্বৈত মানদণ্ডের কারণে পশ্চিমা দেশের তথাকথিত নৈতিক নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বহু আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক বলছেন, গাজায় যা চলছে তাতে পশ্চিমাদের এই নিস্ক্রিয়তা তাদের নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করে দিচ্ছে এবং এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে গণ্য হচ্ছে। মরক্কো ভিত্তিক একজন বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন, “গাজায় চলমান গণহত্যার ওপর পশ্চিমাদের নীরবতা তাদের আত্মঘোষিত নৈতিক নেতৃত্বকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে” – কেননা নির্বাচিত নিন্দা ও selective outrage এর মাধ্যমে তারা দেখিয়ে দিচ্ছে যে মানবাধিকার রক্ষা তাদের কাছে সর্বত্র সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়

কিছু পশ্চিমা নেতা অবশ্য নিন্দা করেছেন বেসামরিক মৃত্যু বৃদ্ধির, তবে সেটি অনেক দেরিতে এবং অনেকটাই জনচাপের মুখে। সাম্প্রতিক দিনে আয়ারল্যান্ড, স্পেন, নিউজিল্যান্ডের মতো কয়েকটি দেশ জোরালোভাবে গাজায় যুদ্ধ বিরতি ও অবরোধ প্রত্যাহারের পক্ষে কণ্ঠ তুলেছে। তবে বৈশ্বিক মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি প্রমুখ প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান পরিবর্তন না হলে বাস্তবে পরিস্থিতি বদলাবে না।

দ্বৈত নীতির এই উদাহরণ শুধু বর্তমান নয়, ঐতিহাসিকভাবেই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্বের এক ধরণের পক্ষপাত দেখা গেছে। ফিলিস্তিনিদের অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টিতে তারা প্রায়শই ন্যূনতম প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে থাকে, যা বিশ্বজুড়ে সচেতন মহলে বিস্ময় ও ক্ষোভের সৃষ্টি করছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন: যদি মানবাধিকার সর্বজনীন হয়, তবে গাজার শিশুদের জীবনের মূল্য কি অন্য কারো চেয়ে কম? এই কঠোর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের তাঁদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

অবরোধের নৈতিক ও মানবিক দিক

গাজায় মানবিক সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার ফলে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা কেবল রাজনৈতিক বা আইনি সংকট নয় – এটি গভীরভাবে নৈতিক ও মানবিক সংকটনিরীহ শিশু, নারী ও পুরুষদের শাস্তি হিসেবে অভুক্ত রাখা এবং মৌলিক মানবিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত করা নৈতিকতার সমস্ত সীমা লঙ্ঘন করে। যুদ্ধের নীতিমালায় অথবা যেকোনো সভ্য সমাজের মূল্যবোধে এ ধরনের আচরণের কোনও স্থান নেই।

গাজার চিকিৎসাকর্মীরা এবং মানবাধিকার কর্মীরা প্রতিদিন যেসব দৃশ্যের মুখোমুখি হচ্ছেন তা সত্যিই দুঃস্বপ্নের মতো। একজন চিকিৎসক ডা. তানিয়া হাজ-হাসান গাজার পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “আমি প্রতিদিন শিশুদেরকে সবরকমভাবে মারা যেতে দেখছি – সেটা হোক বোমার আঘাতে, ঠান্ডায় জমে, ক্ষুধায়, রোগে – এবং এগুলো সবই ঘটছে সুচারুভাবে পরিকল্পিত এক সামরিক অভিযান এবং অবরোধের কারণে, যেটা সম্ভব হয়েছে কিছু দেশের নীরব সমর্থনে” । তাঁর এই মর্মস্পর্শী বাক্যগুলো আমাদের মনে বড় একটি নৈতিক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়: কীভাবে আমরা মানবতা হিসেবে এটা মেনে নিচ্ছি যে শিশুদের এভাবে মরতে হবে?

গাজায় আজ পুরো একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠছে ধ্বংস, অভাব এবং আতঙ্কের মধ্য দিয়ে। তাদের কাছে শৈশব মানে বোমার শব্দ, বাবা-মায়ের উৎকণ্ঠা, অনাহার এবং আশ্রয়হীন রাত। কিছু শিশুর জন্মই হয়েছে অবরোধের মধ্যে, যারা জীবনে কখনো পর্যাপ্ত খাবার বা সুপেয় পানি পায়নি। একটা শিশুর জন্য নিরাপদ আশ্রয় এবং খাদ্য পাওয়া সবচেয়ে মৌলিক অধিকার – সেই অধিকারই গাজার শিশুদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। কোনও নৈতিক মানদণ্ড দিয়েই এর সাফাই দেয়া অসম্ভব।

মানবিক মূল্যবোধের আরেকটি স্তরে النظر করলে দেখা যায়, গাজার অবরোধ আমাদের সম্মিলিত মানবতার প্রতি এক বিরাট আঘাত। রেড ক্রসের নীতিমালা হোক বা জাতিসংঘের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র – সর্বত্রই নিরপরাধ মানুষের কষ্ট লাঘবের কথা বলা হয়েছে, যুদ্ধের মাঝেও ন্যূনতম মানবিক আচরণের কথা বলা হয়েছে। গাজায় সেসব নীতিকে পদদলিত করে মনুষ্যত্ববোধকেই চ্যালেঞ্জ জানানো হচ্ছে। এটা শুধু ফিলিস্তিনি জনগণের পরীক্ষাই নয়, বরং গোটা বিশ্বের মানবিক চেতনাবোধেরও পরীক্ষা। আমরা কি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে দেখবো নাকি জোরালো কণ্ঠে বলবো যে এই নিষ্ঠুরতা চলতে পারে না – সেটাই এখানে প্রশ্ন।

পাশাপাশি, ইসরায়েলি সমাজ ও বিশ্বের অনেক বিবেকবান ইহুদী মানুষও এই অবরোধের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। অনেকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে ইতিহাসে ইহুদী জাতি নিজেরাও নিষ্ঠুর অবরোধ ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে; সেই অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও আজ ইসরায়েলের সরকার একই ধরণের কৌশল প্রয়োগ করছে, যা ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। ইসরায়েলের ভেতরেও সামান্য হলেও এমন কণ্ঠ রয়েছে যারা এই পথকে ভুল বলছেন, কিন্তু যুদ্ধকালীন জাতীয়তাবাদের উত্তেজনায় সেসব কণ্ঠ চাপা পড়ে যাচ্ছে।

সত্যিটা হলো, গাজার এই অবরোধ মানবিকতার ওপরে কালিমা এঁকে দিচ্ছে। “গাজায় মানবতা ধ্বংস করা হচ্ছে, আর আমরা তা চোখের সামনে দেখেও মুখ ফিরিয়ে আছি” – MSF কর্মী পলা গিলের এই সতর্কবাণী আমাদের সকলের কাছে এক উদাত্ত আহ্বান। এটি শুধু ফিলিস্তিন বা মধ্যপ্রাচ্যের সংকট নয়, এটি মানবতার সংকট। এখানে ন্যায়বোধ বনাম নির্মমতা, সহানুভূতি বনাম উদাসীনতার এক পরীক্ষার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এই পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে আমাদের সভ্যতার মূল্যবোধও হেরে যাবে।

সংকটের সম্ভাব্য সমাধান: পথ কী?

প্রশ্ন ওঠে, এত গুরুতর পরিস্থিতির সমাধান কীভাবে সম্ভব? গাজার মানবিক বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দ্রুত ও দীর্ঘমেয়াদী – উভয় ধরনের পদক্ষেপই দরকার। নিম্নে সম্ভাব্য কিছু সমাধান এবং পদক্ষেপ তুলে ধরা হলো:

  1. তাৎক্ষণিক মানবিক যুদ্ধবিরতি ও অবরোধ প্রত্যাহার: অবিলম্বে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে হবে এবং সকল পক্ষকে তাতে সম্মত হতে হবে। যুদ্ধবিরতির সাথে সাথেই ইসরায়েলকে গাজার স্থল, জল ও আকাশপথের অবরোধ তুলে নিতে হবে অথবা অন্তত মানবিক করিডর খুলতে হবে যাতে পর্যাপ্ত ত্রাণ, খাদ্য, পানি, জ্বালানি এবং ওষুধ প্রবেশ করতে পারে। এই পদক্ষেপটি জীবনরক্ষার জন্য সর্বপ্রথম ও অত্যাবশ্যক। আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করে হলেও ইসরায়েলকে এই মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দিতে বাধ্য করতে হবে।
  2. আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ও ত্রাণ বিতরণে সহযোগিতা: গাজায় ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা ও বণ্টনে স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ বা নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মোতায়েন করা যেতে পারে। একটি আন্তর্জাতিক মানবিক টাস্কফোর্স গঠন করে ত্রাণবাহী যানবাহনগুলোর নিরাপদ চলাচল ও বিতরণ নিশ্চিত করা সম্ভব। এতে করে ইসরায়েল নিরাপত্তা নিয়ে যে শঙ্কার কথা বলে, তাও প্রশমিত হবে এবং ত্রাণ সহায়তা সুষ্ঠুভাবে জনগণের কাছে পৌঁছবে।
  3. রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উদ্যোগ: দীর্ঘমেয়াদে গাজা সংকটের টেকসই সমাধানের জন্য একটি বিস্তৃত রাজনৈতিক সমাধান আবশ্যক। এতে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড (গাজা ও পশ্চিম তীর) থেকে ইসরায়েলি অবৈধ অবরোধ ও দখলদারিত্বের অবসান, এবং দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে অগ্রসর হওয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সমন্বয়ে নতুন করে শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে, যেখানে গাজার শাসনব্যবস্থা, নিরাপত্তা ও পুনর্গঠন নিয়ে পরিকল্পনা হবে। উদাহরণসরূপ, সাম্প্রতিক কালে মিশর, জর্ডানসহ কয়েকটি আরব দেশ একসাথে মিলে গাজা পুনর্গঠন ও সেখানে একটি নতুন শাসন ব্যবস্থা গড়ার প্রস্তাব দিয়েছিল, যাতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ভূমিকা থাকছে এবং প্রায় ৫৩ বিলিয়ন ডলারের পুনর্নিমাণ তহবিলের কথা ছিল। এই ধরণের উদ্যোগগুলোকে আন্তর্জাতিক সমর্থন দিয়ে বাস্তব রূপ দিতে হবে।
  4. মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ: বিশ্ব সম্প্রদায়কে প্রমাণ করতে হবে যে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করলে ছাড় পাওয়া যায় না। ইসরায়েলের ওপর কূটনৈতিক চাপ বাড়াতে হবে যেন তারা জেনেভা কনভেনশনসহ আন্তর্জাতিক মানবিক আইন মেনে চলে। যদি অবরোধ ও হামলা একইভাবে চলতে থাকে, তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মাধ্যমে বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা জোরদার করা উচিত। এছাড়াও যুদ্ধাপরাধের দায়ে কিছু দেশের ক্ষেত্রে যেমন নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, ইসরায়েলের ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ (যেমন অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা) নিয়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। এই ধরণের পদক্ষেপের হুমকি ইসরায়েলকে তার নীতি পুনর্বিবেচনায় বাধ্য করতে পারে।
  5. পশ্চিমা শক্তিগুলোর নীতিগত পরিবর্তন: যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর ভূমিকা পরিবর্তন করা এই সংকট নিরসনের চাবিকাঠি। তাদের জনগণের মধ্যেও ব্যাপক চাপ তৈরি হচ্ছে মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করার জন্য। ফলে, এই দেশগুলোর সরকার যদি তাদের দ্বৈত নীতি পরিত্যাগ করে গাজার মানুষের জীবনরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়, তাহলে ইসরায়েলের ওপর দ্রুত প্রভাব পড়বে। পশ্চিমা বিশ্বের উচিত হবে ইসরায়েলের নিরাপত্তার বৈধ চাহিদা ও ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকারের মধ্যে ভারসাম্য এনে গঠনমূলক ভূমিকা নেওয়া। উদাহরণ হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরায়েলকে স্পষ্ট বার্তা দেয় যে অবরোধ চালিয়ে গেলে তাদের সমর্থন বিপন্ন হবে, তবে তা পরিস্থিতি পাল্টে দিতে পারে।
  6. মানবিক পুনর্গঠন ও সহায়তা পরিকল্পনা: অবরোধ উঠে গেলে শুধু ত্রাণ পাঠালেই হবে না, গাজার দীর্ঘমেয়াদী পুনর্গঠন এবং মনস্তাত্ত্বিক পুনরুদ্ধারের জন্য বিশাল পরিকল্পনা দরকার। এর জন্য আন্তর্জাতিক দাতা সম্মেলন ডেকে বিপুল তহবিল সংগ্রহ, অবকাঠামো ও বাড়িঘর নির্মাণ, হাসপাতাল ও স্কুল পুনর্নিমাণ, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার সংস্কার ইত্যাদি দ্রুত শুরু করতে হবে। বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ সহ অন্যান্য সংস্থা এবং ধনী রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে একটি পুনর্গঠন তহবিল গঠন করা যেতে পারে। এতে গাজার জনগণ আশার আলো দেখতে পাবে এবং চরমপন্থার মাটি দুর্বল হবে।

সমাধানের পথ সহজ নয়, বিশেষত যখন সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোতে অবিশ্বাস ও শত্রুতা এত গভীরে। তবুও, মানবিক কারণেই বিশ্বকে এই সংকট সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। এখানে দেরি মানেই আরও শিশু অপুষ্টিতে মারা যাবে, আরও পরিবার ঠান্ডায় জমে যাবে, আরও প্রজন্ম ঘৃণা ও ব্যথা নিয়ে বড় হবে – যা ভবিষ্যতে শান্তির সম্ভাবনাকেও ক্ষীণ করবে।

উপসংহার

গাজার জনগণের জন্য বর্তমান অবরোধ এক অবর্ণনীয় দুর্ভোগের নাম, যেখানে প্রতিটি দিন টিকে থাকাই একেকটি চ্যালেঞ্জ। এই অবরোধ মানবতার বিরুদ্ধে একটি অপরাধ, যা আন্তর্জাতিক আইন, ন্যায়বোধ এবং নৈতিকতার প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। বিশ্ব যদি এখনো জাগ্রত না হয়, যদি এখনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।

আজকে যারা গাজার জন্য দাঁড়াচ্ছেন না, নীরব সমর্থন যোগাচ্ছেন এই অবরোধকে, ভবিষ্যতে তাদের ভূমিকাও সমালোচিত হবে। মানবিক সহায়তা পাওয়া প্রতিটি মানুষের অধিকার – এই মৌলিক সত্যটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। গাজার শিশু যে একই রক্ত-মাংসের মানুষ এবং তাদের বাঁচার অধিকার আমাদের সন্তানদের মতোই মূল্যবান, তা স্বীকার করে নিতে হবে সবাইকে।

সবচেয়ে বড় কথা, এই সংকটের সমাধান শুধু রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটি আমাদের মানবতার পরীক্ষাও। বিপন্ন মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো, জুলুমের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা – এটাই মানবতার ডাকে সাড়া দেওয়া। গাজায় অবরোধ তুলে নিয়ে অবাধে মানবিক সাহায্য প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া, এবং দীর্ঘমেয়াদে সেখানে ন্যায়সঙ্গত শান্তি প্রতিষ্ঠা করা – এটিই এই নিষ্ঠুর অধ্যায়ের ইতি টানার একমাত্র পথ। বিশ্ব যদি সত্যিই মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করে, তবে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে গাজার জনগণকে বাঁচানোর দায়িত্ব তারই। মানবিকতার পক্ষে দাঁড়িয়ে অবরোধ ভেঙে গাজায় আশার আলো ফিরিয়ে আনা এখন সমগ্র বিশ্বের নৈতিক দায়িত্ব।

Share.
Leave A Reply

error: Content is protected !!
Exit mobile version