গত ১৫ মার্চ, ২০২৫ তারিখে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইয়েমেনের রাজধানী সানায় ইরান-সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে একটি বড় ধরনের বিমান হামলার নির্দেশ দিয়েছেন। এই হামলায় অন্তত ৩১ জন নিহত এবং ১০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে বলে হুথি নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই হামলার কথা ঘোষণা করে বলেছেন, তিনি “অপ্রতিরোধ্য শক্তি” ব্যবহার করে হুথিদের আক্রমণ বন্ধ করবেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো—কেন এই হামলা? এর পেছনে কী কারণ লুকিয়ে আছে? আসুন, বাস্তবতাটা খুঁজে বের করি।

হুথি বিদ্রোহীদের উত্থান ও লোহিত সাগরে আক্রমণ

ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা, যারা আনুষ্ঠানিকভাবে “আনসার আল্লাহ” নামে পরিচিত, ২০১৪ সাল থেকে দেশের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। ইরানের সমর্থন নিয়ে তারা গত এক দশক ধরে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে হুথিরা লোহিত সাগরে জাহাজের ওপর আক্রমণ চালানো শুরু করে। তারা দাবি করে, ইসরায়েল বা তার মিত্রদের (যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য) সঙ্গে যুক্ত জাহাজগুলো তাদের লক্ষ্য, এবং এটি ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশের একটি উপায়।

কিন্তু বাস্তবে, হুথিদের আক্রমণ শুধু ইসরায়েলি জাহাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তারা ১০০টিরও বেশি বাণিজ্যিক জাহাজে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, দুটি জাহাজ ডুবিয়েছে এবং চারজন নাবিককে হত্যা করেছে। এই আক্রমণগুলো লোহিত সাগরের ব্যস্ত শিপিং রুটকে ব্যাহত করেছে, যা বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ১৫% পরিচালনা করে। ফলে, অনেক শিপিং কোম্পানি দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল বিকল্প রুট ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছে। ট্রাম্প তার বক্তব্যে বলেছেন, এই “অবিরাম জলদস্যুতা, সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদ” বন্ধ করতে তিনি বাধ্য হয়েছেন।

USA Navy Attacks Huthi of Yemen

ট্রাম্পের কৌশল: শক্তি প্রদর্শন ও ইরানকে সতর্কতা

ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এটি তার প্রথম বড় সামরিক পদক্ষেপ। তিনি স্পষ্টভাবে একটি সামাজিক  পোস্টে বলেছেন যে তিনি ইয়েমেনের হুথি-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে বিমান হামলার নির্দেশ দিয়েছেন এবং ইরান-সমর্থিত এই বিদ্রোহীরা গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথে জাহাজ চলাচল বন্ধ না করা পর্যন্ত “বিপুল প্রাণঘাতী শক্তি” ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন । ট্রাম্পের মতে, “আমাদের সাহসী যোদ্ধারা আমেরিকান শিপিং, বিমান এবং নৌ সম্পদ রক্ষা এবং নৌ চলাচলের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করতে এই মুহূর্তে সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি, নেতা এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপর বিমান হামলা চালাচ্ছে”। তিনি আরও বলেন, “কোনও সন্ত্রাসী শক্তি আমেরিকান বাণিজ্যিক ও নৌ জাহাজকে বিশ্বের জলপথে অবাধে চলাচল করতে বাধা দিতে পারবে না” । ট্রাম্প এই হামলাগুলিকে “decisive and powerful Military action” হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং হুথিদের আক্রমণ বন্ধ না হলে “HELL WILL RAIN DOWN UPON YOU LIKE NOTHING YOU HAVE EVER SEEN BEFORE!” বলে হুমকি দিয়েছেন ।

এই বিমান হামলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল ইরানের উপর চাপ সৃষ্টি করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে হুথি বিদ্রোহীদের ইরানের মদদপুষ্ট হিসেবে দেখে আসছে । ট্রাম্প তার বার্তায় ইরানের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, “ইরানের হুথিদের সমর্থন অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। আমেরিকার জনগণ বা তাদের প্রেসিডেন্টকে হুমকি দিলে আমরা পুরোপুরি জবাবদিহি করব।” এটি শুধু হুথিদের বিরুদ্ধে নয়, ইরানের “অ্যাক্সিস অফ রেজিস্ট্যান্স” নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে একটি পরোক্ষ হুমকিও বটে।

কেন এখন?

হুথিরা গত জানুয়ারিতে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে জাহাজে আক্রমণ বন্ধ করেছিল। কিন্তু সম্প্রতি তারা ঘোষণা করে, ইসরায়েল যদি গাজায় ত্রাণ সরবরাহের ওপর অবরোধ অব্যাহত রাখে, তবে তারা আবারও ইসরায়েলি জাহাজে আক্রমণ শুরু করবে। এই হুমকির কয়েকদিন পরই ট্রাম্পের নির্দেশে হামলা শুরু হয়। এটি থেকে বোঝা যায়, তিনি হুথিদের আগেই “শায়েস্তা” করতে চান, যাতে লোহিত সাগরে আর কোনো বাধা না আসে।

তবে, এই হামলার সময়ও লক্ষণীয়। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ট্রাম্প ইরানের নেতৃত্বের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে। এই হামলা কি সেই আলোচনার আগে শক্তি প্রদর্শনের একটি অংশ? নাকি ইরানকে চাপে রাখার কৌশল?

বাস্তবতা ও প্রভাব

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া সম্ভবত বিভক্ত হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা সম্ভবত এই পদক্ষেপকে সমর্থন করবে, তবে অন্যরা উত্তেজনা বৃদ্ধি এবং বেসামরিক হতাহতের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারে। এই ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এককভাবে বিমান হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে হুথি হুমকির মোকাবিলায় বিভিন্ন পদ্ধতির ইঙ্গিত দিতে পারে।  

ইয়েমেনের মানবিক সংকট ইতিমধ্যেই বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ। লক্ষ লক্ষ মানুষ সাহায্যের উপর নির্ভরশীল এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে । অন্যদিকে হুথিরা দাবি করেছে, এই হামলায় নারী ও শিশুসহ বেসামরিক মানুষ হতাহত হয়েছে। তারা এটিকে “যুদ্ধাপরাধ” আখ্যা দিয়ে প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছে। সানায় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বিস্ফোরণগুলো এতটাই শক্তিশালী ছিল যে মনে হচ্ছিল ভূমিকম্প হচ্ছে। অন্যদিকে, মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, এই হামলা কয়েক দিন বা সপ্তাহ ধরে চলতে পারে।

Trump Attacks Huthi of Yemen

কিন্তু এই হামলা কি সত্যিই হুথিদের থামাতে পারবে? গত বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইসরায়েল বারবার হুথি ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে, কিন্তু তাদের দমন করা যায়নি। ইরানের শীর্ষ কমান্ডার বলেছেন, হুথিরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, এবং ইরানের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ সীমিত। তাহলে কি এই হামলা শুধুই একটি প্রতীকী পদক্ষেপ?

শেষ কথা

ট্রাম্পের এই হামলার মূল লক্ষ্য মার্কিন স্বার্থ রক্ষা, লোহিত সাগরে বাণিজ্য রুট সুরক্ষিত করা এবং ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। তবে, এটি ইয়েমেনে আরও অস্থিরতা ও মানবিক সংকট বাড়াতে পারে। হুথিদের প্রতিক্রিয়া এবং ইরানের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করবে এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ। বাস্তবতা হলো—এই হামলা হয়তো সাময়িকভাবে শক্তি দেখাতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে শান্তি বা সমাধান আনবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

Share.
Leave A Reply

error: Content is protected !!
Exit mobile version